শ্রাবণী মেলা
"শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের পরে, বুকের পরে।
পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দু নয়ানে..."
শ্রাবণ মানেই বৃষ্টির কথা মনে পড়ে। কিন্তু শ্রাবণ মানে কি শুধুই নিছক অঝোর ধারা ? নাকি অন্য কোনো গুরুত্ব রয়েছে এই মাসটির ! পুরাণ থেকে বয়ে আসা সনাতন ঐতিহ্যের এক বিপুল ধারা রয়েছে শ্রাবণ মাসের সঙ্গে। হিন্দু পরম্পরায় শ্রাবণ এক অতি পবিত্র মাস।
শ্রাবণ শব্দের উৎসে রয়েছে শ্রবণ,এবং এই নামটি এসেছে শ্রবণা নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। পুরাণ অনুসারে এই মাসেই ঘটেছিলো সমুদ্র মন্থন। মন্থনের ফলে উঠে আসা বিষকে নিজের কণ্ঠে ধারণ করে সৃষ্টিকে রক্ষা করেছিলেন মহাদেব,তাই এই শ্রাবণ মাসকে উৎসর্গিত করা হয় মহাদেবের উদ্দেশ্যে।
প্রবাদ রয়েছে,বাঙালির 'বারো মাসে তেরো পার্বন।' বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেই এই প্রবাদটির সত্যতা মেলে। বছরের নানা সময়ে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় 'মেলা' নামক উৎসবমুখর অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। মেলা বাঙালি ঐতিহ্যের অন্যতম অঙ্গ হলেও নির্দিষ্ট কিছু মেলা বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে। বাঙালির তেমনই একটি লোক সংস্কৃতির মেলা, পুণ্য অর্জনের মেলা ---'শ্রাবণী মেলা'।
গুরু পূর্ণিমা থেকে শুরু হয় এই শ্রাবণী মেলা তারকেশ্বরে এবং শেষ হয় রাখী পূর্ণিমার দিন। বৈদ্যবাটির নিমাই তীর্থ ঘাট থেকে গঙ্গার জল তুলে বাঁকে করে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে ভক্তরা পৌঁছন পুণ্যতীর্থ তারকেশ্বরে। আবার অনেক ভক্ত বৈদ্যবাটি চৌমাথা হয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দিয়ে সিঙ্গুর, হরিপাল হয়ে তাঁরা শিবের মাথায় জল ঢালেন পুণ্য লাভের আশায়। এর পর আগামী একমাস ধরে চলে ভক্ত সমাগম ও লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী জল ঢালেন মহাদেবের মাথায়। এই উপলক্ষে গোটা তারকেশ্বর জুড়ে পড়ে যায় সাজো সাজো রব। পুণ্য অর্জনের ভীড়ে জমে ওঠে শ্রাবণী মেলা।
মেলা মানেই হরেক রঙের কাঁচের চুড়ি, নাগরদোলা, মিঠাই, পুতুল, সার্কাস আরও কতো কি। মেলায় আসা সাপুড়িয়ারা বলে, ভক্তি করতে হবে এই জ্যান্ত দেবতাকে তবেই নাকি মহাদেব তুষ্ট হন। তারকেশ্বরের বাবা তারকনাথের তুষ্টিতেই যেনো জনগণের শান্তি। গোটা শ্রাবণ মাস চলে যায় শিব ভক্তদের দখলে। জল যাত্রীদের জন্য পসরা সাজিয়ে বহু মানুষ বসে পড়ে আশপাশের গ্রাম থেকে। প্লাস্টিকের ঘট, মাটির কলসি, ফুল, বেলপাতা, গেরুয়া পোশাক, গামছা, তোয়ালে, বাঁক, বাঁক সাজানোর উপকরণ আরও কতো কি নিয়ে ! এভাবেই চলে হিন্দুদের শিব মহিমা। আসলে শ্রাবণ যে মহাদেবের বড়ো প্রিয় মাস। তারকেশ্বরের তারকনাথ, মেদিনীপুরের খড়গেশ্বর,বলিপুরের সুরথ রাজার আরাধ্য সুরথেশ্বর, সাঁইথিয়ার কলেশ্বর, বর্ধমানের একশো আট শিব মন্দির, দেওঘরের বৈদ্যনাথ এবং ময়নাগুড়ির জল্পেশের শ্রাবণী মেলা যেনো নিজের ঐতিহ্য নিজেই বহন করে। ময়নাগুড়ির এই শ্রাবণী মেলায় প্রতি বছর মরিচবাড়ি তিস্তা ঘাট থেকে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী জল নিয়ে পায়ে হেঁটে জল্পেশ মন্দিরে যান। এই ঐতিহ্যবাহী মেলায় শুধুমাত্র জলপাইগুড়ির বাসিন্দারাই নন, আসাম,সিকিম এমনকি নেপাল ,ভুটান থেকেও ভক্তের সমাগম হয়। ভক্তেরা তিস্তার ঘাট থেকে জল ভরে প্রায় ১৫-১৬ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে মন্দিরে আসেন। রবিবার সারাদিন সারারাত হেঁটে সোমবার জল ঢালেন মহাদেবের মাথায়। আসলে পুরাণ বলে সোমবারকে শিবের জন্ম বার।
নতুন মাটির কলস, নতুন,বাঁক, নতুন গৈরিকবাস নিয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা যুগ যুগ ধরে চলেছে এই পথ চলায়। কিন্তু, কিসের এই পথ চলা ? কিসের এই আকুতি ? কিসের এই সংযম? মহাদেব নাকি ভক্তের এই বয়ে আনা জলেই তুষ্ট হন ! কাঁধে বাঁক রাখলেই কি শুধু কঠোর সংযম ? আর বাঁক কাঁধ থেকে নামালেই আবার শুদ্ধ হয়ে তবে পূর্ণযাত্রা ! মন্দ, ভালো,পুণ্য, পাপ স্খালনের আশায় কি এই ব্রত ! ভক্তদের পথ চলায় তাই হয়তো অনুরণিত হয়,
"ভোলেবাবা পার লাগাও, ত্রিশূলধারী শক্তি জাগাও, ব্যোম ব্যোম তারক ব্যোম ভোলে ব্যোম তারক ব্যোম..." এই শব্দ গুলো বারে বারে আর সেই সাথে থাকে টুং টাং ঘণ্টা ধ্বনি।
আবারও মনে পড়ে আমার ঠাকুরের সেই কথাগুলি,
"আজ শ্রাবণের সজল ছায়ায় বিরহ--মিলন..."
এ যেন এক অদ্ভুত মিলন আমাদের । শ্রাবণ আসে শ্রাবণ যায় । শুধু রেখে যায় তার স্মৃতি, উৎসবের চিহ্ন, মহামিলনের বার্তা।
সুমি ভট্টাচার্য্য ।
তথ্যসূত্র : বিভিন্ন ওয়েবসাইট ।
"শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের পরে, বুকের পরে।
পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দু নয়ানে..."
শ্রাবণ মানেই বৃষ্টির কথা মনে পড়ে। কিন্তু শ্রাবণ মানে কি শুধুই নিছক অঝোর ধারা ? নাকি অন্য কোনো গুরুত্ব রয়েছে এই মাসটির ! পুরাণ থেকে বয়ে আসা সনাতন ঐতিহ্যের এক বিপুল ধারা রয়েছে শ্রাবণ মাসের সঙ্গে। হিন্দু পরম্পরায় শ্রাবণ এক অতি পবিত্র মাস।
শ্রাবণ শব্দের উৎসে রয়েছে শ্রবণ,এবং এই নামটি এসেছে শ্রবণা নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। পুরাণ অনুসারে এই মাসেই ঘটেছিলো সমুদ্র মন্থন। মন্থনের ফলে উঠে আসা বিষকে নিজের কণ্ঠে ধারণ করে সৃষ্টিকে রক্ষা করেছিলেন মহাদেব,তাই এই শ্রাবণ মাসকে উৎসর্গিত করা হয় মহাদেবের উদ্দেশ্যে।
প্রবাদ রয়েছে,বাঙালির 'বারো মাসে তেরো পার্বন।' বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেই এই প্রবাদটির সত্যতা মেলে। বছরের নানা সময়ে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় 'মেলা' নামক উৎসবমুখর অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। মেলা বাঙালি ঐতিহ্যের অন্যতম অঙ্গ হলেও নির্দিষ্ট কিছু মেলা বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে। বাঙালির তেমনই একটি লোক সংস্কৃতির মেলা, পুণ্য অর্জনের মেলা ---'শ্রাবণী মেলা'।
গুরু পূর্ণিমা থেকে শুরু হয় এই শ্রাবণী মেলা তারকেশ্বরে এবং শেষ হয় রাখী পূর্ণিমার দিন। বৈদ্যবাটির নিমাই তীর্থ ঘাট থেকে গঙ্গার জল তুলে বাঁকে করে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে ভক্তরা পৌঁছন পুণ্যতীর্থ তারকেশ্বরে। আবার অনেক ভক্ত বৈদ্যবাটি চৌমাথা হয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দিয়ে সিঙ্গুর, হরিপাল হয়ে তাঁরা শিবের মাথায় জল ঢালেন পুণ্য লাভের আশায়। এর পর আগামী একমাস ধরে চলে ভক্ত সমাগম ও লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী জল ঢালেন মহাদেবের মাথায়। এই উপলক্ষে গোটা তারকেশ্বর জুড়ে পড়ে যায় সাজো সাজো রব। পুণ্য অর্জনের ভীড়ে জমে ওঠে শ্রাবণী মেলা।
মেলা মানেই হরেক রঙের কাঁচের চুড়ি, নাগরদোলা, মিঠাই, পুতুল, সার্কাস আরও কতো কি। মেলায় আসা সাপুড়িয়ারা বলে, ভক্তি করতে হবে এই জ্যান্ত দেবতাকে তবেই নাকি মহাদেব তুষ্ট হন। তারকেশ্বরের বাবা তারকনাথের তুষ্টিতেই যেনো জনগণের শান্তি। গোটা শ্রাবণ মাস চলে যায় শিব ভক্তদের দখলে। জল যাত্রীদের জন্য পসরা সাজিয়ে বহু মানুষ বসে পড়ে আশপাশের গ্রাম থেকে। প্লাস্টিকের ঘট, মাটির কলসি, ফুল, বেলপাতা, গেরুয়া পোশাক, গামছা, তোয়ালে, বাঁক, বাঁক সাজানোর উপকরণ আরও কতো কি নিয়ে ! এভাবেই চলে হিন্দুদের শিব মহিমা। আসলে শ্রাবণ যে মহাদেবের বড়ো প্রিয় মাস। তারকেশ্বরের তারকনাথ, মেদিনীপুরের খড়গেশ্বর,বলিপুরের সুরথ রাজার আরাধ্য সুরথেশ্বর, সাঁইথিয়ার কলেশ্বর, বর্ধমানের একশো আট শিব মন্দির, দেওঘরের বৈদ্যনাথ এবং ময়নাগুড়ির জল্পেশের শ্রাবণী মেলা যেনো নিজের ঐতিহ্য নিজেই বহন করে। ময়নাগুড়ির এই শ্রাবণী মেলায় প্রতি বছর মরিচবাড়ি তিস্তা ঘাট থেকে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী জল নিয়ে পায়ে হেঁটে জল্পেশ মন্দিরে যান। এই ঐতিহ্যবাহী মেলায় শুধুমাত্র জলপাইগুড়ির বাসিন্দারাই নন, আসাম,সিকিম এমনকি নেপাল ,ভুটান থেকেও ভক্তের সমাগম হয়। ভক্তেরা তিস্তার ঘাট থেকে জল ভরে প্রায় ১৫-১৬ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে মন্দিরে আসেন। রবিবার সারাদিন সারারাত হেঁটে সোমবার জল ঢালেন মহাদেবের মাথায়। আসলে পুরাণ বলে সোমবারকে শিবের জন্ম বার।
নতুন মাটির কলস, নতুন,বাঁক, নতুন গৈরিকবাস নিয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা যুগ যুগ ধরে চলেছে এই পথ চলায়। কিন্তু, কিসের এই পথ চলা ? কিসের এই আকুতি ? কিসের এই সংযম? মহাদেব নাকি ভক্তের এই বয়ে আনা জলেই তুষ্ট হন ! কাঁধে বাঁক রাখলেই কি শুধু কঠোর সংযম ? আর বাঁক কাঁধ থেকে নামালেই আবার শুদ্ধ হয়ে তবে পূর্ণযাত্রা ! মন্দ, ভালো,পুণ্য, পাপ স্খালনের আশায় কি এই ব্রত ! ভক্তদের পথ চলায় তাই হয়তো অনুরণিত হয়,
"ভোলেবাবা পার লাগাও, ত্রিশূলধারী শক্তি জাগাও, ব্যোম ব্যোম তারক ব্যোম ভোলে ব্যোম তারক ব্যোম..." এই শব্দ গুলো বারে বারে আর সেই সাথে থাকে টুং টাং ঘণ্টা ধ্বনি।
আবারও মনে পড়ে আমার ঠাকুরের সেই কথাগুলি,
"আজ শ্রাবণের সজল ছায়ায় বিরহ--মিলন..."
এ যেন এক অদ্ভুত মিলন আমাদের । শ্রাবণ আসে শ্রাবণ যায় । শুধু রেখে যায় তার স্মৃতি, উৎসবের চিহ্ন, মহামিলনের বার্তা।
সুমি ভট্টাচার্য্য ।
তথ্যসূত্র : বিভিন্ন ওয়েবসাইট ।
0 Comments
Posting any kind of spam in comment section is prohibited
Emoji