গৃহী সন্ন্যাসী
অতি অল্প বয়সেই 'কথামৃত', 'শতরূপে সারদা' ইত্যাদি হাতে এসে পড়ে আমার; কিন্তু ওই বইগুলোর গুরুত্ব তখন বুঝি নি। তোতাপাখির মতো আউড়ে গেছিলাম আর বইটি কে লিখেছেন এবং কার সম্বন্ধে লিখেছেন সেটাই শুধুমাত্র তখন জেনেছিলাম। আমার আসল আকর্ষণ ছিলো অন্য যা আমি তখন বুঝেও বুঝিনি। একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় যে, প্রতি মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনে পরিচিতের ছদ্মবেশে চিরবিস্ময় যেন হাতের ছোঁয়ার মধ্যেই ধরা দিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন,
'ঘর হতে শুধু দু পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু...'
এই শিশিরবিন্দুকেও আমরা খোঁজার তাড়নায় ছুটি দূরে, বহুদূরে। দুর্লভ যে একান্ত ভাবেই সুলভের মধ্যেই বিদ্যমান থাকে তা সত্যিই তো আমরা ভুলে যাই।
আমার আজকের লেখা 'গৃহী সন্ন্যাসী'। এই লেখার শুরুতেই আমি সেই পবিত্র আত্মাকে আমার পরম প্রিয় মানুষটিকে প্রণাম জানাই যার জন্য এই অমৃতের ভাণ্ডারের স্বাদ আমি আবার নতুন করে পেলাম। মায়ের কথায় বলি,"শুদ্ধ মনই তো মানুষকে পথ দেখিয়ে নেয়। দুষ্ট মনকে যদি মোড় ফিরিয়ে দাও,তবেই সে ইষ্টকে ধরতে পারে।"
আচ্ছা, গৃহী কি কখনো সন্ন্যাসী হতে পারে ? এটা কি সম্ভব ? দুটি যে বিপরীত মেরু। গৃহী অর্থাৎ গার্হস্থ্য কর্মে যিনি আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আর সন্ন্যাস মানে সাংসারিক বন্ধন থেকে যিনি মুক্ত। কিন্ত গৃহী হয়েও যে সন্ন্যাসী হওয়া যায় তা আমাদের হাতে করে ধরে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন প্রাণের ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেব। আর শুধুমাত্র শ্রী রামকৃষ্ণ দেবই নয় ; এই হাতে ধরে শিক্ষা সারদা মা ও শিখিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের।
অবতারপুরুষের স্বরূপ সাধারণ মানুষের বুদ্ধির অগম্য। তাঁকে চিনে নেন তাঁর লীলাপার্ষদরা ,বা বলা যায় তিনি ধরা দেন লীলাপার্ষদদের কাছে। শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের জীবনের ক্ষেত্রেও আমরা এটি লক্ষ্য করেছি। গৃহে বাস করে কি উপায়ে দেবভাবে জীবন কাটানো যায় ,কি উপায়ে সাংসারিক সুখ দুঃখ সমান ভাবে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকা যায় তা শিখিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি। অখণ্ড সচ্চিদানন্দ ,বাক্য মনের অতীত প্রাণের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দেবকে নিয়ে কি লিখবো আর কি লিখবনা জানি না। ঠাকুরের কথায়,'কুঁড়ে ঘরে হাতি ঢুকলে তোলপাড় করে দেয়'---আমার এখন সেই অবস্থা হয়ে গেছে।
প্রথমেই আসি ঐতিহাসিক ফলহারিণী কালীপুজোর রাত্রে শ্রী মাকে ষোড়শী রূপে পুজো করা প্রসঙ্গে। পুজোর আগেই শ্রী মাকে দেবীর আসনে বসিয়ে ঠাকুর আহ্বান মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন,
"হে বালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরাসুন্দরী, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত করো, ইহার শরীর মনকে পবিত্র করিয়া ইহাতে আবির্ভুতা হইয়া সর্বকল্যান সাধন করো।"
পুজো শেষে দেবীর কাছে নিজেকে নিবেদন করে নিজের সমস্ত সাধনার ফল,জপের মালা প্রভৃতি সর্বস্ব তাঁর চরণে চিরকালের জন্য সমর্পণ করেছিলেন। কোন দৃষ্টিতে যে ঠাকুর মাকে দেখতেন ষোড়শী পুজোই তার শেষ কথা বলে। জগতের সাধন ইতিহাসে এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত। দীর্ঘ আট মাস শ্রী রামকৃষ্ণ দেব সারদা দেবীকে অতি নিকটে রেখেও তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র দেহবুদ্ধির প্রকাশ পাননি। পরবর্তী কালে ঠাকুর পবিত্রতা স্বরূপিনি মায়ের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন,
"ও যদি এতো ভালো না হতো, আত্মহারা হয়ে তখন আমাকে আক্রমণ করতো,তাহলে সংযমের বাঁধ ভেঙে দেহবুদ্ধি আসতো কি না কে বলতে পারে ?"
ঠাকুর মাকে দেখতেন তিন রকম ভাবে : শিষ্যা রূপে,পতিব্রতা রূপে এবং সাক্ষাৎ জগদীশ্বরী রূপে। এই প্রসঙ্গে স্বামী নির্বেদানন্দ বলেছিলেন,'রামকৃষ্ণ দেবের চোখে সারদা দেবীর নিষ্কলঙ্ক মন যেন একটি মহামূল্য মণির মতো : তার নানা দিকে প্রতিফলিত তাঁর ব্যক্তিত্বের নানা রূপ : স্ত্রী, সন্ন্যাসিনি,শিষ্যা,জগজ্জননী---প্রতিটি রূপই পূর্ণ। সম্পূর্ণ বিপরীতের কি আশ্চর্য সমন্বয় !' ঠাকুর মা সম্বন্ধে বলতেন,
"ও সারদা--সরস্বতী--জ্ঞান দিতে এসেছে। ও কি যে সে! ও আমার শক্তি!"
এই 'শক্তি' শব্দটি ঠাকুর বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেছেন। সাধারণত বিবাহিত পত্নীকে শক্তি বলা হয় ,কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি 'ব্রহ্ম ও শক্তি' র কথাই ইঙ্গিত করেছেন। ঠাকুর জানতেন যে, 'জীবদ্ধার ব্রত' রূপ কার্যের জন্য তাঁর আবির্ভাব হলেও তাঁর লীলা সঙ্গিনীর ভূমিকা তাতে কোনো অংশে কম ছিলো না। ঠাকুর যখন মহাপ্রস্থানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন সেই সময় তিনি মাকে বলেছিলেন নিজেকে দেখিয়ে অনুযোগের সুরে।
"তুমি কি কিছু করবে না? এই সব করবে ?এ আর কি করেছে? তোমাকে এর চেয়ে অনেক বেশি করতে হবে।"
ঠাকুর মাকে কোনোদিন 'তুই' বলেও সম্বোধন অবধি করেননি। শ্রী মায়ের প্রতি সম্ভ্রম প্রদর্শন ও সৌজন্য প্রকাশের ব্যাপারে ঠাকুর সর্বদা সচেতন থাকতেন। আসলে স্বামী এবং স্ত্রীর জীবন যে কতোখানি সামঞ্জস্য পূর্ণ হতে পারে তার দৃষ্টান্ত শুধুই মা আর ঠাকুর। স্বামীর পত্নীপূজা ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ভারত ও ভারতের বহু জায়গায় নারী যখন অপমানিত তখন ঠাকুর নিজের স্ত্রীকে দেবীরূপে পুজো করে সম্মান ও গৌরবে ভূষিত করেছেন। ঠাকুর বলেন,
"সংসারে সঙও আছে সারও আছে।মায়াও আছে বস্তুও আছে। সার যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা মাতৃত্ব ছাড়া আর কি। আর এই সার যিনি দেন তিনিই সারদা।"
শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের সমস্ত সাধনার সারভূতা প্রতিমা শ্রী মা। ঠাকুর বলেতেন,
'কর্ম যে বরাবরই করতে হবে তা নয়, ঈশ্বর লাভ হলে আর কর্ম থাকে না। ফল হলে ফুল এমনিই ঝরে যায়। একজন ভক্ত একবার জিজ্ঞেস করেছিল ঠাকুরকে,
'আচ্ছা, সংসারে কেমন করে থাকতে হয়?' ঠাকুর বলেছিলেন,
'পাঁকাল মাছের মতো থাকবে। সংসার থেকে তফাতে গিয়ে নির্জনে ঈশ্বর চিন্তা মাঝে মাঝে করলে,তাঁতে ভক্তি জন্মে। তখন নির্লিপ্ত হয়ে থাকতে পারবে। পাঁক আছে, পাঁকের ভিতর থাকতে হয় তবুও গায়ে পাঁক লাগে না। সে লোক অনাসক্ত হয়ে সংসারে থাকে।'
ঠাকুর এই সময় লক্ষ্য করলেন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত অর্থাৎ শ্রী ম বলে যাঁকে আমরা চিনি উনি একাগ্র চিত্তে ওনার কথা শুনেছেন। তাই তাঁর দিকে তাকিয়ে ঠাকুর বললেন,
'তীব্র বৈরাগ্য হলে তবে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। যার তীব্র বৈরাগ্য হয়, তার বোধ হয় সংসার দাবানল! জ্বলছে! এদিকের আনন্দ পেলে ওটা আর ভালো লাগে না। ভগবানের আনন্দ লাভ করলে সংসার আলুনি বোধ হয়।'
এই সময় ত্রৈলোক্য নামে এক ভক্ত ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলো,'সংসার যারা করছে আমি তাদের কথা বলছি---যারা ত্যাগী তাদের কথা বলছি না।' ঠাকুর তখন বললেন,
'ও-সব তোমাদের কি কথা!--যারা 'সংসার ধর্ম' করছে তারা একবার যদি ভগবানের আনন্দ পায় তাদের আর কিছু ভালো লাগবে না। কাজের সব আঁট কমে যায়, ক্রমে যত আনন্দ বাড়ে কাজ আর করতে পারে না। একবার এই আনন্দের আস্বাদ পেলে,তখন সংসার থাকে আর যায়।'
যতদিন যায় শ্রী ম এইসব কথা শুনিয়া ভাবেন,'এই সৌম্য কে ? যাঁর কাছে ফিরে যেতে বার বার মন চাহে।' ঠাকুরের কথা শুনে শ্রী ম এক অদ্ভুত টান অনুভব করলেন ঠিক যেন বঁড়শিতে গাঁথা মাছ। তিনি জানালেন ঠাকুরের কাছে তাঁর সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হওয়ার তীব্র বাসনা। ঠাকুর বললেন,
'মা আমাকে বলেছেন, তোমাকে তাঁর একটু কাজ করতে হবে--লোককে 'ভাগবত' শোনাতে হবে। মা 'ভাগবতের' পণ্ডিতকে একটা বাঁধন দিয়ে সংসারে রেখে দেন।'
তবুও তিনি সন্ন্যাসের জন্য পীড়াপীড়ি করলে ঠাকুর বলেন,
'কেহ যেন মনে না করে আমি না হলে মায়ের কাজ চলবে না। মা একটা তৃণ থেকে বড়ো আচার্য তৈরি করতে পারেন।'
ঠাকুরের ইচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে শ্রী ম নিজ গৃহে সন্ন্যাসী হলেন। ঠাকুর বলছেন,
"এই সংসারে বন্ধন আর মুক্তি এই দুয়ের কর্তাই তিনি। তাঁর মায়াতে সংসারী জীব কামিনী কাঞ্চনে বদ্ধ আবার তাঁর দয়াতেই মুক্ত। গৃহে সন্ন্যাস নেওয়ার উপায় হলো একমাত্র নির্জনে সাধন। সব কাজ করলেও মন যেনো ঈশ্বরে থাকে ,ঠিক যেমন বড়লোক বাড়ির দাসী। যতই এখানে কাজ করুক মন পড়ে থাকে দেশে নিজের বাড়িতে। মনিবের ছেলেকে যতই নিজের ছেলে বলে আদর করুক মন জানে এরা কিন্তু আমার কেউ নয়। তেল হাতে মেখে কাঁঠাল ভাঙলে যেমন হাতে আঠা জড়িয়ে যায় না ঠিক তেমনি ঈশ্বরে ভক্তিরূপ তেল হাতে নিয়ে সংসারের কাজে হাত দিতে হয়। তাই এই ভক্তি লাভ করতে হলেই নির্জন হওয়া চাই। নির্জনে ঈশ্বর চিন্তা করলে জ্ঞান ,বৈরাগ্য ভক্তি লাভ হয়। মন হলো দুধের মতো আর এই দুধ রূপ মনকে সংসার জলে ফেলে রাখলে দুধে জলে মিশে যাবে। তাই দুধকে নির্জনে দই পেতে মাখন তুলতে হয়। যখন নির্জনে সাধন করে মন রূপ দুধ থেকে জ্ঞান ভক্তি রূপ মাখন তোলা হলো তখন সেই মাখন অনায়াসে সংসার জলে রাখা যায়। সে মাখন আর সংসার জলে মিশে যাবে না---সংসার জলের ওপর নির্লিপ্ত হয়ে ভাসবে। আসল কথা হলো মন। মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত।"
শ্রী ম র জীবনে অক্ষয় কীর্তি 'কথামৃত'। গৃহস্থ শ্রী ম র সঙ্গে মিশে বহু যুবক হলেন শ্রী রামকৃষ্ণ মঠের সন্ন্যাসী। এই একটি বিষয়ই যথেষ্ট প্রমাণ কি রূপ গৃহী ছিলেন শ্রী ম। অন্তরে পূর্ণ সন্ন্যাস নিয়ে তিনি ছিলেন গৃহে এবং জগতকে শোনালেন 'ভাগবত'।গৃহে থেকে ত্যাগ,তপস্যা, সেবার ব্রত পালন করে গেলেন তাঁর বৃদ্ধ বয়েস পর্যন্ত। 'কথামৃত' বইটি সম্বন্ধে তিনি বলতেন,'খুব ভালো একটা background তৈরি করে তবে এই সব কথা অপরকে শোনাতে হয়। যেমন, Daimond---মাটিতে রাখলে একরকম, ঘাসের ওপর রাখলে একরকম, কাঠের ওপর রাখলে একরকম। কিন্তু ভেলভেটের ওপর রাখলে তার brilliance সবচাইতে বেশি বাড়ে।' স্বামী বিবেকানন্দ একবার উচ্ছসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন,
"You have hit Ramkrishna to the right point...It is indeed wonderful.The move is quite original...It has been reserved for you this great work."
শ্রী মা বলেছিলেন,"একদিন তোমার মুখে (কথামৃত) শুনিয়া আমার বোধ হইল যে তিনিই(ঠাকুর) ঐ সমস্ত কথা বলিতেছেন।"
এবার আসি স্বামীজীর কথায়। গৃহী ও সন্ন্যাসী উভয়ের জন্য আছে তাঁর রচিত বই 'কর্মযোগ'। তাঁর মতে কাজ তো কেবল সন্ন্যাসীদের করলেই হবে না গৃহীদেরও করতে হবে। স্বামীজী বলেছিলেন,
"... he must struggle hard to acquire these things-- firstly knowledge, secondly wealth. এই সম্পদের এক অংশ যেমন ব্যয় করবেন আত্মীয় পরিজনদের জন্য তেমনি সমাজের প্রতি দায়িত্ব ভুললেও চলবে না। If you want to be a householder, hold your life a sacrifice for the welfare of others."
এবার যাঁকে ছাড়া প্রাণের ঠাকুর অসম্পূর্ণ তাঁর কথায় আসি। মা। শ্রী মা ছিলেন এমনই এক নারী যিনি স্বামীর নিঃস্বার্থ সেবা এবং তাঁর ঈশ্বর সাধনার পথে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করে আদর্শ ভারতীয় গৃহিণীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিতা হন। মা বলতেন,
"সংসারে সব দুটি দুটি। এই দেখ না---চোখ দুটি,কান দুটি, হাত দুটি,পা দুটি তেমনি পুরুষ ও প্রকৃতি।"
আমাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে ঠাকুর বিবাহ করলেন কেন ? অন্তরে বাইরে সন্ন্যাসী শ্রী রামকৃষ্ণের এই যে বিবাহ বন্ধন, এ বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই হয়েছিল।প্রধান উদ্দেশ্য হলো, প্রকৃত দাম্পত্য জীবনের আদর্শ কেমন হওয়া উচিৎ সে সম্পর্কে গৃহস্থদের বলা এবং পরস্পরের মধ্যের সম্পর্ক, বোঝাপড়া করে জীবনকে কতটা মধুময় করে তোলা যায়। আবার গৃহস্থকে উপদেশ দিলেন,"একটি দুটি সন্তানের জন্মের পর ভাইবোনের মতো থাকতে।" অর্থাৎ জীবন থেকে ভোগবাসনাকে একেবারে বর্জন করতে বললেন না কারণ অধিকাংশের পক্ষেই তা সম্ভব নয়।তবে ক্রমশ মোড় ফেরাতে বললেন ঈশ্বরাভিমুখে। স্বামী ঈশ্বর পরায়ণ, তেমনি স্ত্রীও ঈশ্বর পরায়ণ না হলে এমনটি সম্ভব হতো না। ঠাকুর যখন শ্রী মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
"তুমি কি আমাকে সংসার পথে টানতে এসেছ ?" উপযুক্তা সহধর্মীনির মতো তিনি বলেছিলেন,"তোমার ইষ্ট পথেই সাহায্য করতে এসেছি।"
যুগাবতার শ্রী রামকৃষ্ণ দেব জগতকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নির্বাচন করেছিলেন দুটি শ্রেষ্ঠ আধারকে। একজন হলেন সারদারূপী তাঁর সহধর্মিনী এবং অন্যজন হলেন নরেন্দ্ররূপী তাঁদের দিব্য সন্তান। একজনের মধ্যে দিয়ে প্রচার করলেন মাতৃভাব আর আরেকজনের মধ্যে দিয়ে বেদান্তের অমৃতবার্তা।
'গৃহী সন্ন্যাসী' লেখার জন্য আমার অমৃতের খনির দিকে আবার ফিরে দেখা আর ফের দেখার সম্পর্ক হয়ে গেল। এই সম্পর্ক ততোটাই নিবিড় যতটা দিন ও রাতের সম্পর্ক। এই 'অমৃতকথা' লেখার সৌভাগ্যের অধিকারিণী কোনো দিন হবো বলেই ভাবি নি। ঠাকুর মায়ের ইচ্ছায় যাঁর জন্য আজ এই অমূল্য খনির সন্ধান আবারও পেলাম,আমার সেই পরম প্রিয় মানুষটিকে আবারও প্রণাম জানিয়ে শেষ করি কারণ মায়ের কথাই আজ মনে হচ্ছে খুব ,
"ভাঙতে সবাই পারে ,গড়তে পারে ক'জনে? নিন্দা, ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই কিন্তু কি করে যে তাকে ভালো করতে হবে , তা বলতে পারে ক'জনে ?"
সুমি ভট্টাচার্য্য
তথ্যসূত্র : শতরূপে সারদা ---সম্পাদক স্বামী লোকেশ্বরানন্দ।
তথ্যসূত্র : পরমপদকমলে -- শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।
তথ্যসূত্র : শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত ,অখণ্ড-------শ্রী ম কথিত।
অতি অল্প বয়সেই 'কথামৃত', 'শতরূপে সারদা' ইত্যাদি হাতে এসে পড়ে আমার; কিন্তু ওই বইগুলোর গুরুত্ব তখন বুঝি নি। তোতাপাখির মতো আউড়ে গেছিলাম আর বইটি কে লিখেছেন এবং কার সম্বন্ধে লিখেছেন সেটাই শুধুমাত্র তখন জেনেছিলাম। আমার আসল আকর্ষণ ছিলো অন্য যা আমি তখন বুঝেও বুঝিনি। একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় যে, প্রতি মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনে পরিচিতের ছদ্মবেশে চিরবিস্ময় যেন হাতের ছোঁয়ার মধ্যেই ধরা দিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন,
'ঘর হতে শুধু দু পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু...'
এই শিশিরবিন্দুকেও আমরা খোঁজার তাড়নায় ছুটি দূরে, বহুদূরে। দুর্লভ যে একান্ত ভাবেই সুলভের মধ্যেই বিদ্যমান থাকে তা সত্যিই তো আমরা ভুলে যাই।
আমার আজকের লেখা 'গৃহী সন্ন্যাসী'। এই লেখার শুরুতেই আমি সেই পবিত্র আত্মাকে আমার পরম প্রিয় মানুষটিকে প্রণাম জানাই যার জন্য এই অমৃতের ভাণ্ডারের স্বাদ আমি আবার নতুন করে পেলাম। মায়ের কথায় বলি,"শুদ্ধ মনই তো মানুষকে পথ দেখিয়ে নেয়। দুষ্ট মনকে যদি মোড় ফিরিয়ে দাও,তবেই সে ইষ্টকে ধরতে পারে।"
আচ্ছা, গৃহী কি কখনো সন্ন্যাসী হতে পারে ? এটা কি সম্ভব ? দুটি যে বিপরীত মেরু। গৃহী অর্থাৎ গার্হস্থ্য কর্মে যিনি আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আর সন্ন্যাস মানে সাংসারিক বন্ধন থেকে যিনি মুক্ত। কিন্ত গৃহী হয়েও যে সন্ন্যাসী হওয়া যায় তা আমাদের হাতে করে ধরে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন প্রাণের ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেব। আর শুধুমাত্র শ্রী রামকৃষ্ণ দেবই নয় ; এই হাতে ধরে শিক্ষা সারদা মা ও শিখিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের।
অবতারপুরুষের স্বরূপ সাধারণ মানুষের বুদ্ধির অগম্য। তাঁকে চিনে নেন তাঁর লীলাপার্ষদরা ,বা বলা যায় তিনি ধরা দেন লীলাপার্ষদদের কাছে। শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের জীবনের ক্ষেত্রেও আমরা এটি লক্ষ্য করেছি। গৃহে বাস করে কি উপায়ে দেবভাবে জীবন কাটানো যায় ,কি উপায়ে সাংসারিক সুখ দুঃখ সমান ভাবে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকা যায় তা শিখিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি। অখণ্ড সচ্চিদানন্দ ,বাক্য মনের অতীত প্রাণের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দেবকে নিয়ে কি লিখবো আর কি লিখবনা জানি না। ঠাকুরের কথায়,'কুঁড়ে ঘরে হাতি ঢুকলে তোলপাড় করে দেয়'---আমার এখন সেই অবস্থা হয়ে গেছে।
প্রথমেই আসি ঐতিহাসিক ফলহারিণী কালীপুজোর রাত্রে শ্রী মাকে ষোড়শী রূপে পুজো করা প্রসঙ্গে। পুজোর আগেই শ্রী মাকে দেবীর আসনে বসিয়ে ঠাকুর আহ্বান মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন,
"হে বালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরাসুন্দরী, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত করো, ইহার শরীর মনকে পবিত্র করিয়া ইহাতে আবির্ভুতা হইয়া সর্বকল্যান সাধন করো।"
পুজো শেষে দেবীর কাছে নিজেকে নিবেদন করে নিজের সমস্ত সাধনার ফল,জপের মালা প্রভৃতি সর্বস্ব তাঁর চরণে চিরকালের জন্য সমর্পণ করেছিলেন। কোন দৃষ্টিতে যে ঠাকুর মাকে দেখতেন ষোড়শী পুজোই তার শেষ কথা বলে। জগতের সাধন ইতিহাসে এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত। দীর্ঘ আট মাস শ্রী রামকৃষ্ণ দেব সারদা দেবীকে অতি নিকটে রেখেও তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র দেহবুদ্ধির প্রকাশ পাননি। পরবর্তী কালে ঠাকুর পবিত্রতা স্বরূপিনি মায়ের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন,
"ও যদি এতো ভালো না হতো, আত্মহারা হয়ে তখন আমাকে আক্রমণ করতো,তাহলে সংযমের বাঁধ ভেঙে দেহবুদ্ধি আসতো কি না কে বলতে পারে ?"
ঠাকুর মাকে দেখতেন তিন রকম ভাবে : শিষ্যা রূপে,পতিব্রতা রূপে এবং সাক্ষাৎ জগদীশ্বরী রূপে। এই প্রসঙ্গে স্বামী নির্বেদানন্দ বলেছিলেন,'রামকৃষ্ণ দেবের চোখে সারদা দেবীর নিষ্কলঙ্ক মন যেন একটি মহামূল্য মণির মতো : তার নানা দিকে প্রতিফলিত তাঁর ব্যক্তিত্বের নানা রূপ : স্ত্রী, সন্ন্যাসিনি,শিষ্যা,জগজ্জননী---প্রতিটি রূপই পূর্ণ। সম্পূর্ণ বিপরীতের কি আশ্চর্য সমন্বয় !' ঠাকুর মা সম্বন্ধে বলতেন,
"ও সারদা--সরস্বতী--জ্ঞান দিতে এসেছে। ও কি যে সে! ও আমার শক্তি!"
এই 'শক্তি' শব্দটি ঠাকুর বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেছেন। সাধারণত বিবাহিত পত্নীকে শক্তি বলা হয় ,কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি 'ব্রহ্ম ও শক্তি' র কথাই ইঙ্গিত করেছেন। ঠাকুর জানতেন যে, 'জীবদ্ধার ব্রত' রূপ কার্যের জন্য তাঁর আবির্ভাব হলেও তাঁর লীলা সঙ্গিনীর ভূমিকা তাতে কোনো অংশে কম ছিলো না। ঠাকুর যখন মহাপ্রস্থানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন সেই সময় তিনি মাকে বলেছিলেন নিজেকে দেখিয়ে অনুযোগের সুরে।
"তুমি কি কিছু করবে না? এই সব করবে ?এ আর কি করেছে? তোমাকে এর চেয়ে অনেক বেশি করতে হবে।"
ঠাকুর মাকে কোনোদিন 'তুই' বলেও সম্বোধন অবধি করেননি। শ্রী মায়ের প্রতি সম্ভ্রম প্রদর্শন ও সৌজন্য প্রকাশের ব্যাপারে ঠাকুর সর্বদা সচেতন থাকতেন। আসলে স্বামী এবং স্ত্রীর জীবন যে কতোখানি সামঞ্জস্য পূর্ণ হতে পারে তার দৃষ্টান্ত শুধুই মা আর ঠাকুর। স্বামীর পত্নীপূজা ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ভারত ও ভারতের বহু জায়গায় নারী যখন অপমানিত তখন ঠাকুর নিজের স্ত্রীকে দেবীরূপে পুজো করে সম্মান ও গৌরবে ভূষিত করেছেন। ঠাকুর বলেন,
"সংসারে সঙও আছে সারও আছে।মায়াও আছে বস্তুও আছে। সার যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা মাতৃত্ব ছাড়া আর কি। আর এই সার যিনি দেন তিনিই সারদা।"
শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের সমস্ত সাধনার সারভূতা প্রতিমা শ্রী মা। ঠাকুর বলেতেন,
'কর্ম যে বরাবরই করতে হবে তা নয়, ঈশ্বর লাভ হলে আর কর্ম থাকে না। ফল হলে ফুল এমনিই ঝরে যায়। একজন ভক্ত একবার জিজ্ঞেস করেছিল ঠাকুরকে,
'আচ্ছা, সংসারে কেমন করে থাকতে হয়?' ঠাকুর বলেছিলেন,
'পাঁকাল মাছের মতো থাকবে। সংসার থেকে তফাতে গিয়ে নির্জনে ঈশ্বর চিন্তা মাঝে মাঝে করলে,তাঁতে ভক্তি জন্মে। তখন নির্লিপ্ত হয়ে থাকতে পারবে। পাঁক আছে, পাঁকের ভিতর থাকতে হয় তবুও গায়ে পাঁক লাগে না। সে লোক অনাসক্ত হয়ে সংসারে থাকে।'
ঠাকুর এই সময় লক্ষ্য করলেন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত অর্থাৎ শ্রী ম বলে যাঁকে আমরা চিনি উনি একাগ্র চিত্তে ওনার কথা শুনেছেন। তাই তাঁর দিকে তাকিয়ে ঠাকুর বললেন,
'তীব্র বৈরাগ্য হলে তবে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। যার তীব্র বৈরাগ্য হয়, তার বোধ হয় সংসার দাবানল! জ্বলছে! এদিকের আনন্দ পেলে ওটা আর ভালো লাগে না। ভগবানের আনন্দ লাভ করলে সংসার আলুনি বোধ হয়।'
এই সময় ত্রৈলোক্য নামে এক ভক্ত ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলো,'সংসার যারা করছে আমি তাদের কথা বলছি---যারা ত্যাগী তাদের কথা বলছি না।' ঠাকুর তখন বললেন,
'ও-সব তোমাদের কি কথা!--যারা 'সংসার ধর্ম' করছে তারা একবার যদি ভগবানের আনন্দ পায় তাদের আর কিছু ভালো লাগবে না। কাজের সব আঁট কমে যায়, ক্রমে যত আনন্দ বাড়ে কাজ আর করতে পারে না। একবার এই আনন্দের আস্বাদ পেলে,তখন সংসার থাকে আর যায়।'
যতদিন যায় শ্রী ম এইসব কথা শুনিয়া ভাবেন,'এই সৌম্য কে ? যাঁর কাছে ফিরে যেতে বার বার মন চাহে।' ঠাকুরের কথা শুনে শ্রী ম এক অদ্ভুত টান অনুভব করলেন ঠিক যেন বঁড়শিতে গাঁথা মাছ। তিনি জানালেন ঠাকুরের কাছে তাঁর সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হওয়ার তীব্র বাসনা। ঠাকুর বললেন,
'মা আমাকে বলেছেন, তোমাকে তাঁর একটু কাজ করতে হবে--লোককে 'ভাগবত' শোনাতে হবে। মা 'ভাগবতের' পণ্ডিতকে একটা বাঁধন দিয়ে সংসারে রেখে দেন।'
তবুও তিনি সন্ন্যাসের জন্য পীড়াপীড়ি করলে ঠাকুর বলেন,
'কেহ যেন মনে না করে আমি না হলে মায়ের কাজ চলবে না। মা একটা তৃণ থেকে বড়ো আচার্য তৈরি করতে পারেন।'
ঠাকুরের ইচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে শ্রী ম নিজ গৃহে সন্ন্যাসী হলেন। ঠাকুর বলছেন,
"এই সংসারে বন্ধন আর মুক্তি এই দুয়ের কর্তাই তিনি। তাঁর মায়াতে সংসারী জীব কামিনী কাঞ্চনে বদ্ধ আবার তাঁর দয়াতেই মুক্ত। গৃহে সন্ন্যাস নেওয়ার উপায় হলো একমাত্র নির্জনে সাধন। সব কাজ করলেও মন যেনো ঈশ্বরে থাকে ,ঠিক যেমন বড়লোক বাড়ির দাসী। যতই এখানে কাজ করুক মন পড়ে থাকে দেশে নিজের বাড়িতে। মনিবের ছেলেকে যতই নিজের ছেলে বলে আদর করুক মন জানে এরা কিন্তু আমার কেউ নয়। তেল হাতে মেখে কাঁঠাল ভাঙলে যেমন হাতে আঠা জড়িয়ে যায় না ঠিক তেমনি ঈশ্বরে ভক্তিরূপ তেল হাতে নিয়ে সংসারের কাজে হাত দিতে হয়। তাই এই ভক্তি লাভ করতে হলেই নির্জন হওয়া চাই। নির্জনে ঈশ্বর চিন্তা করলে জ্ঞান ,বৈরাগ্য ভক্তি লাভ হয়। মন হলো দুধের মতো আর এই দুধ রূপ মনকে সংসার জলে ফেলে রাখলে দুধে জলে মিশে যাবে। তাই দুধকে নির্জনে দই পেতে মাখন তুলতে হয়। যখন নির্জনে সাধন করে মন রূপ দুধ থেকে জ্ঞান ভক্তি রূপ মাখন তোলা হলো তখন সেই মাখন অনায়াসে সংসার জলে রাখা যায়। সে মাখন আর সংসার জলে মিশে যাবে না---সংসার জলের ওপর নির্লিপ্ত হয়ে ভাসবে। আসল কথা হলো মন। মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত।"
শ্রী ম র জীবনে অক্ষয় কীর্তি 'কথামৃত'। গৃহস্থ শ্রী ম র সঙ্গে মিশে বহু যুবক হলেন শ্রী রামকৃষ্ণ মঠের সন্ন্যাসী। এই একটি বিষয়ই যথেষ্ট প্রমাণ কি রূপ গৃহী ছিলেন শ্রী ম। অন্তরে পূর্ণ সন্ন্যাস নিয়ে তিনি ছিলেন গৃহে এবং জগতকে শোনালেন 'ভাগবত'।গৃহে থেকে ত্যাগ,তপস্যা, সেবার ব্রত পালন করে গেলেন তাঁর বৃদ্ধ বয়েস পর্যন্ত। 'কথামৃত' বইটি সম্বন্ধে তিনি বলতেন,'খুব ভালো একটা background তৈরি করে তবে এই সব কথা অপরকে শোনাতে হয়। যেমন, Daimond---মাটিতে রাখলে একরকম, ঘাসের ওপর রাখলে একরকম, কাঠের ওপর রাখলে একরকম। কিন্তু ভেলভেটের ওপর রাখলে তার brilliance সবচাইতে বেশি বাড়ে।' স্বামী বিবেকানন্দ একবার উচ্ছসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন,
"You have hit Ramkrishna to the right point...It is indeed wonderful.The move is quite original...It has been reserved for you this great work."
শ্রী মা বলেছিলেন,"একদিন তোমার মুখে (কথামৃত) শুনিয়া আমার বোধ হইল যে তিনিই(ঠাকুর) ঐ সমস্ত কথা বলিতেছেন।"
এবার আসি স্বামীজীর কথায়। গৃহী ও সন্ন্যাসী উভয়ের জন্য আছে তাঁর রচিত বই 'কর্মযোগ'। তাঁর মতে কাজ তো কেবল সন্ন্যাসীদের করলেই হবে না গৃহীদেরও করতে হবে। স্বামীজী বলেছিলেন,
"... he must struggle hard to acquire these things-- firstly knowledge, secondly wealth. এই সম্পদের এক অংশ যেমন ব্যয় করবেন আত্মীয় পরিজনদের জন্য তেমনি সমাজের প্রতি দায়িত্ব ভুললেও চলবে না। If you want to be a householder, hold your life a sacrifice for the welfare of others."
এবার যাঁকে ছাড়া প্রাণের ঠাকুর অসম্পূর্ণ তাঁর কথায় আসি। মা। শ্রী মা ছিলেন এমনই এক নারী যিনি স্বামীর নিঃস্বার্থ সেবা এবং তাঁর ঈশ্বর সাধনার পথে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করে আদর্শ ভারতীয় গৃহিণীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিতা হন। মা বলতেন,
"সংসারে সব দুটি দুটি। এই দেখ না---চোখ দুটি,কান দুটি, হাত দুটি,পা দুটি তেমনি পুরুষ ও প্রকৃতি।"
আমাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে ঠাকুর বিবাহ করলেন কেন ? অন্তরে বাইরে সন্ন্যাসী শ্রী রামকৃষ্ণের এই যে বিবাহ বন্ধন, এ বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই হয়েছিল।প্রধান উদ্দেশ্য হলো, প্রকৃত দাম্পত্য জীবনের আদর্শ কেমন হওয়া উচিৎ সে সম্পর্কে গৃহস্থদের বলা এবং পরস্পরের মধ্যের সম্পর্ক, বোঝাপড়া করে জীবনকে কতটা মধুময় করে তোলা যায়। আবার গৃহস্থকে উপদেশ দিলেন,"একটি দুটি সন্তানের জন্মের পর ভাইবোনের মতো থাকতে।" অর্থাৎ জীবন থেকে ভোগবাসনাকে একেবারে বর্জন করতে বললেন না কারণ অধিকাংশের পক্ষেই তা সম্ভব নয়।তবে ক্রমশ মোড় ফেরাতে বললেন ঈশ্বরাভিমুখে। স্বামী ঈশ্বর পরায়ণ, তেমনি স্ত্রীও ঈশ্বর পরায়ণ না হলে এমনটি সম্ভব হতো না। ঠাকুর যখন শ্রী মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
"তুমি কি আমাকে সংসার পথে টানতে এসেছ ?" উপযুক্তা সহধর্মীনির মতো তিনি বলেছিলেন,"তোমার ইষ্ট পথেই সাহায্য করতে এসেছি।"
যুগাবতার শ্রী রামকৃষ্ণ দেব জগতকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নির্বাচন করেছিলেন দুটি শ্রেষ্ঠ আধারকে। একজন হলেন সারদারূপী তাঁর সহধর্মিনী এবং অন্যজন হলেন নরেন্দ্ররূপী তাঁদের দিব্য সন্তান। একজনের মধ্যে দিয়ে প্রচার করলেন মাতৃভাব আর আরেকজনের মধ্যে দিয়ে বেদান্তের অমৃতবার্তা।
'গৃহী সন্ন্যাসী' লেখার জন্য আমার অমৃতের খনির দিকে আবার ফিরে দেখা আর ফের দেখার সম্পর্ক হয়ে গেল। এই সম্পর্ক ততোটাই নিবিড় যতটা দিন ও রাতের সম্পর্ক। এই 'অমৃতকথা' লেখার সৌভাগ্যের অধিকারিণী কোনো দিন হবো বলেই ভাবি নি। ঠাকুর মায়ের ইচ্ছায় যাঁর জন্য আজ এই অমূল্য খনির সন্ধান আবারও পেলাম,আমার সেই পরম প্রিয় মানুষটিকে আবারও প্রণাম জানিয়ে শেষ করি কারণ মায়ের কথাই আজ মনে হচ্ছে খুব ,
"ভাঙতে সবাই পারে ,গড়তে পারে ক'জনে? নিন্দা, ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই কিন্তু কি করে যে তাকে ভালো করতে হবে , তা বলতে পারে ক'জনে ?"
সুমি ভট্টাচার্য্য
তথ্যসূত্র : শতরূপে সারদা ---সম্পাদক স্বামী লোকেশ্বরানন্দ।
তথ্যসূত্র : পরমপদকমলে -- শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।
তথ্যসূত্র : শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত ,অখণ্ড-------শ্রী ম কথিত।
0 Comments
Posting any kind of spam in comment section is prohibited
Emoji