মার্লবোরো

'ধুত্তোর' বলে ফোন টা কেটে দেয় অর্কপ্রভ। মিলির সাথে ওর এতক্ষণ কথা হল প্রায় দিন চারেক পর। মিলি যেনো বুঝতেই চায় না ওর পরিস্থিতিটা। আশ্চর্য মেয়ে। ওরকম বড়লোকের বাড়ির মেয়ে বলেই সেভাবে আঁচ পায়নি এই প্যান্ডেমিকের। ইদানীং বড্ড বিরক্তি লাগে মিলির সাথে কথা বলতে। কিন্তু ওই যে, নয় নয় করেও তো ছটা বছর কাটিয়ে ফেলল একসাথে। হ্যাঁ, সেই শুরুর দিকের আগুন হয়তো এখন নিভু নিভু। কিন্তু সেটারই বা কি দোষ। মাঝে মাঝে জ্বালানি না দিলে আজীবন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলবে সেটা আশা করাই তো ধৃষ্টতা।

মিলির বাড়িতে অর্ক গেছে মোটে দুবার। আর ওর বাবা মার সাথে দেখা হয়েছে একবার। ওনারা যে খুব আপ্যায়ন করেছিলেন, তা তো নয়ই, বরং ওনাদের ব্যাবহার খুব একটা পছন্দ হয়নি অর্কর। অর্ককে যে ওনাদের মনে ধরবে না সে বিষয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মিলির বাবা এবং মা দুজনেই কলকাতার বুকে বেশ নামকরা ডাক্তার। সাউথের এর দিকে নিজেদের দুটো নার্সিং হোম আছে ওনাদের। মিলি মাস্টার্স করছে যাদবপুর থেকে, এটাই লাস্ট ইয়ার। আর ওদিকে অর্ক, বছর তিনেক আগে কোনোমতে বিএসসি টা উতরে চাকরি করছে এদিকে ওদিকে। প্রথমে ওর এক পাড়ার দাদার সূত্রে একটা প্রাইভেট কলেজের ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট এর কাজ পেয়েছিলো। কিন্তু কলেজ টা ছিল সেই কোন গন্ডগ্রামে। যেতে আসতেই অর্ধেক দিন চলে যেতো। ওখানে এক বছর থেকে, মার্কেটিং চলে আসে অর্ক। ওর কিছু ইতিবাচক চারিত্রিক গুণের জন্যেই হয়তো খুব একটা অসুবিধা হয়নি এই লাইনে। ইনসেন্টিভ, মাসিক টার্গেট এই সমস্ত গুলো যেনো জাগিয়ে তুলেছিল অর্ক কে। কিছু মানুষ থাকে যারা খুব চাপের মধ্যে পূর্ণতা খুঁজে পায়, এও সেই গোত্রের। বরানগরে, গঙ্গার ধারে রূপা মাসিদের একটা ফ্ল্যাট ফাঁকা পড়ে ছিল অনেকদিন। কলকাতায় কাজের সূত্রে থাকতে হবে বলার পর, সেটা পেতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি।  কিন্তু অর্ক খোঁজ খবর রাখে আজকাল, এভাবে কতদিন আর থাকা যায়। শহরতলির দিকে একটা ছোট্ট এক কামরার ঘরেও এর থেকে বেশি স্বাধীনতা আছে। তবে এখানে একটা সুবিধে, এখান থেকে মিলির বাড়ি খুব কাছে, ঠিক তিনটে বাস-স্টপ পরেই। আর ভেতরের রাস্তায় মিনিট কুড়ির হাঁটা পথ। ভালোই চলছিল বেশ, প্রায় প্রতিদিন দেখা সাক্ষাত্ হতো মিলির সাথে, মাঝে মাঝে ওকে কলেজ থেকেও পিক করে নিত অর্ক। সপ্তাহে অন্তত একবার করে সময় বের করে নিয়ে বাগবাজার ঘাট, ভিক্টোরিয়া, সরোবর, অজস্র হাবিজাবি স্ট্রিট ফুড আর কখনো কখনো ওয়াইজ আউল বা হার্ড রক ক্যাফে। হঠাৎ করে মার্চের মাঝের দিকে পনেরো দিনের বন্ধ্টা...

না, শুরুতেই খারাপ লাগেনি ওই হপ্তা দুয়েক। পুরো কাজ ছাদে, বারান্দায় বা লিভিং রুমে ল্যাপটপ এর সামনে বসে হয়ে যেতো। তাড়াতাড়ি ওঠা নেই, রান্না করা নেই, পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি তে শ্যামবাজারের জ্যামে দাঁড়িয়ে চপচপে হয়ে ঘামে ভেজা নেই। যেনো স্বর্গসুখ। উল্টে আগের মাসের থেকে বেশি সেল হল সেই মাসে। কিন্তু সেই থেকে পনেরো দিন টা যে কিভাবে চোখের নিমেষে একশো পঞ্চাশ দিন হয়ে গেলো, ভাবতেও অবাক লাগে।
আবার
কল আসছে।
মিলি।
ফোন টা উল্টে রাখলো অর্ক। পাশের ঘরে গেলো একটা লাল কচ্ছপ ধূপ আনতে। এই রাত্তির হলেই মশা বাড়ে। একটাই ছিল। ড্রয়ার খুলে এক ফালতি কাগজে লিখে রাখলো, 'মশার কয়েল'
মিলি আবার ফোন করছে।
'খুব টায়ার্ড, কাল কথা বলছি। গুড নাইট' মেসেজ টা পাঠিয়ে ফোন এর লক বাটনে দশ সেকেন্ড চাপ দিতেই সব ফাঁকা। ল্যাপটপ নেটফ্লিক্সের কি একটা চলছিল, 'লা কাসা দেল...' কিসব। ব্যাঙ্ক ডাকাতির গল্প। ভালোই বেশ, খারাপ নয়। তবে এইসবে খুব একটা উৎসাহ আসেনা আজকাল। অবশ্য কোনো কালে যে ছিল সেটা বললেও ভুল বলা হবে। মিলিই জোর করেছিলো একটু দেখার জন্যে, ওখানের কোন এক চরিত্রের সাথে নাকি অর্কর খুব মিল। সাড়ে চারটে এপিসোড পরে, এখনও কারুর সাথে নিজের সিকিভাগ ও মিল খুঁজে পায়নি ও । ল্যাপটপ এর স্ক্রিন টা নামিয়ে রেখে একটা বিড়ি ধরায় অর্ক। আজ গুমোট গরম। জানলা খুলেও লাভ হচ্ছে না, একগাদা মশা ঢুকছে শুধু।
রাত
প্রায় সাড়ে বারো। অর্কর হঠাৎ খেয়াল হলো, ডিনার করা হয়নি এখনো। চাউমিনটা দরজার কাছে রাখা। খোলা হয়নি। ডেলিভারি আসার পর থেকে শোভন দার সাথে ফোনে আর মিলির সাথে ঝগড়ায় কখন যে তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে বোঝা যায়নি। বিড়িটা বাগানে ছুঁড়ে ফেলে প্যাকেট টা তুলে আনে অর্ক। কিন্তু খিদে মরে গেছে, কিছুটা বিরক্তি থেকেই হয়তো। কিছুক্ষন ইতস্তত করে, ছোট্ট কোল্ড-ড্রিঙ্কস্ এর বোতল আর লাল কয়েল টা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অর্ক। মেইন গেট এর চাবিটা পকেটেই ছিল। মার্লবোরোর প্যাকেটের সাথে গুঁতোগুঁতি করে জায়গা করে নিয়েছিলো কোনোভাবে। রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই লালু ন্যাজ নাড়তে নাড়তে এসে হাজির। নিশ্চয়ই কোনো খাবার ভেবেছে কোকের বোতল টা কে। ঘাটের দিকে পা বাড়াতেই লালু পিছু নেয় অর্কর। লালু কে কে বোঝায় যে এটা মহাপ্রস্হান নয়।
আজ
ঘাট টা যেনো অস্বাভাবিক রকমের ফাঁকা। দুটোর জায়গায় একটাই আলো জ্বলছে টিমটিম করে। পাঁচিলের পেছন দিকটায় গাঁজাখোর গুলো আজকেই আছে। ঘাটের অন্ধকার দিকটা গাঁজার গন্ধে ভরে গেছে। কতদিন গাঁজা খায়নি অর্ক। সেই লাস্ট কলেজে থাকাকালীন। তারপর কখনো ওই জিনিসের প্রয়োজন পড়েনি। আজ হলে অবশ্য খুব একটা মন্দ হতো না। এইসব ভাবতে ভাবতে একটু নিচের দিকের সিঁড়িতে গোড়োলি ডুবিয়ে বসে পরে ও। পাশে ধূপ টা জ্বলছে। তবে তাতে কোনো কাজ হচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। একটু হাওয়া ছাড়ছে আস্তে আস্তে।
চোখ
টা লেগে গেছিল। সম্বিত ফিরল আন্ডারপ্যান্ট জল লাগার পর। জল উঠছে। কি ভয়ানক ব্যাপার। প্রায় লাফিয়ে দুটো ধাপ ওপরে উঠে আসে অর্ক। না, সাঁতার সে জানে বটে কিন্তু এরকম বেপরোয়া তো সে নয়। চোখ কচলে পকেট হাতড়ে মার্লবোরোর প্যাকেট টা বের করে অর্ক। কিন্তু কি মনে হতে, সেটা রেখে অন্য পকেটের বিড়ির প্যাকেট থেকে একটা বের করে আনে। মাঝে মাঝে ওই দামী সিগারেটের থেকে এক টাকার বিড়ি কাজ দেয় বেশি। আজ লাভ হল প্রায় ষোলো হাজার টাকা। অর্ক এই সেকেন্ড ওয়েভের শুরুতে অনেকগুলো ছোটো ছোটো ব্যবসায় নেমে পড়েছিলো। কয়েকটা সমান সমান পার্টনারশিপ আর কয়েকটা খুচরো, সামান্যই লাভ সেখানে। আজকের টা এলো শোভনদা এর সাথে অক্সিজেনের ডিল টা থেকে। শোভনদা ওর থেকে অনেকটা সিনিয়র। বেশ বুদ্ধিমান লোক। সোজাসাপটা কথা বলে, কোনো চেপে রাখা নেই, পিঠপিছে কথা বলা নেই। এই কারণেই ওর সাথে অর্কর বেশ জমে ভালো। শোভনদা এই লাইনে আছে কম করে বারো-তেরো বছর। লোকটা ধান্ধা জানে। ঠিক কোন সোর্স লাগিয়ে অক্সিজেনের সাপ্লাই চেইন ভিড়ে গেছিল এই বছরের শুরুতে। তখন অক্সিজেনের এরকম আকাল পড়েনি চারদিকে। মাঝে ওই মাস দুয়েক আগে অর্ক ওখানে কিছু টাকা ঢোকায়, শোভনদার তুলনায় নিতান্তই নগন্য। কিন্তু তাতেই যে এরকম লাভ হবে কল্পনা করতে পারেনি অর্ক। এক মাসের মধ্যে যখন প্রাথমিক ইনভেস্টের টাকা টা উঠে গেলো, তখন মনে হয়েছিলো বটে যে নাহ্, ভুল জায়গায় টাকা লাগানো হয়নি। এই ব্যবসাটা পুরোটাই হ্যান্ডেল করে পিউদি, শোভনদার ওয়াইফ। তুখোড় মহিলা, ব্যবসায়িক বুদ্ধি মারাত্মক। ওদের মেয়ে মধুরা একটা বেশ নামজাদা স্কুলে পড়ছে, ক্লাস থ্রি তে। ওদের বাড়িতে অর্কর আনাগোনা অবাধ। শোভনদার মা, কমলা দেবীও বড্ড স্নেহ করেন অর্ককে।
এই অক্সিজেনের ব্যাপারটা খুব সহজ। ওদের কাছে সিলিন্ডার পাওয়া যায় আর ফাঁকা সিলিন্ডার ভর্তি করার সুবিধা আছে। অর্কর হিসেব মত সিলিন্ডার এখনো আছে খান ষাট-সত্তর। রিফিলিং লাভ কম, সিলিন্ডারে অনেক বেশি। এই দু মাসে কম মালদার পার্টি তো দেখলো না ওরা। নব্বই এর ওপর বয়স, অক্সিজেন স্যাচুরেশান চল্লিশ, বুড়োর বাঁচার আশা নেই বললেই চলে। ওদিকে ছেলে এসে সাত সাতটা সিলিন্ডার নিয়ে চলে গেলো। অর্ক আটকাতে যাচ্ছিলো ওনাকে, পিউদির ইশারায় থেমে গেছিল, কিছু বলেনি। ওই কেসটায় লাভ হয়েছিলো প্রচুর। এই ব্যবসাতে আসলে এরকম খদ্দেরেরই দরকার। এরাই লক্ষ্মী। ওদের তিনজনের নাম্বার দেওয়া আছে চারদিকে। সোশাল মিডিয়া তে 'জগন্নাথ অক্সিজেন' বলে সার্চ করলেই পাওয়া যাবে। সারাক্ষণ ফোন আসছে। এই কারণে মাঝে মাঝে অর্ককে ওর দ্বিতীয় ফোন টা সুইচ অফ করে রাখতে হয়। ওদের রেট শুনেই কিছু পার্টি চিৎকার করে ওঠে, কেউ বা একটু কম করতে বলে, কেউ কেউ তো পুলিশে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছে। কিছুই হয়নি শেষ পর্যন্ত। দিনে গড়ে মোটামুটি দু-তিনটে সিলিন্ডার আর দশ-কুড়িটা রিফিল তো হেসেখেলে হচ্ছে। এর কাছে ওই স্যানিটাইজার আর অক্সিমিটারের ব্যবসা টা মলিন হয়ে গেছে। ওটা তে যে লাভ হয় না সেইরকম নয় কিন্তু এর সামনে ওগুলো নস্যি।

'দাদা আগুন হবে?'

শুনে পেছন ফেরে অর্ক। মধ্যবয়স্ক লোক, পরণে শার্ট-প্যান্ট। শার্টের বোতাম গুলো খোলা। গায়ের রং শ্যামলা। মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে। একটা বিড়ি হতে দাঁড়িয়ে। ওই গাঁজাখোর দলের কেউ বলে তো মনে হয় না।

'হ্যাঁ, নিন না' বলে একটা জ্বলন্ত দেশলাই এগিয়ে দেয় অর্ক।

'না দাদা, ওতো কাছে না যাওয়াই ভালো, কারুর মুখে মাস্ক নেই তো'

ঠিক তো। অর্ক খেয়ালই করেনি যে ওর মুখে মাস্ক নেই। রাতে ঘাট ফাঁকা থাকে বলেই কি মাস্ক পড়ে আসার কথা মনে হয়নি? কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না অর্ক। লোকটা এরই মধ্যে তলা থেকে ধূপ টা তুলে এনে, সেটা থেকে বিড়ি ধরিয়ে নিয়েছে। বেশ বুদ্ধিসুদ্ধি আছে বটে।

'তো আপনি...?' নেহাত ভদ্রতার খাতিরে হাওয়াতে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় অর্ক।

'আমি রামভিলাস, মালদা থেকে আসছি'

একটা হিন্দি টান আছে লোকটার কথায়। 'আমি অর্কপ্রভ... আপনি মালদা থেকে আসছেন মানে? এই এতো রাতে এসে পৌঁছলেন নাকি?'

'হ্যাঁ, আসলে বাস টা খুব দেরী করে ফেললো। তারপর বাবুঘাট থেকে হেঁটে দেরি হয়ে গেলো'

'বলেন কি মশাই! আপনি বাবুঘাট থেকে এতদূর হেঁটে এলেন?'

ফিক করে হেসে বিড়ি তে লম্বা টান দেয় রামবিলাস। অর্কর চোখ তখন ছানাবড়া। বলে কি লোকটা।

'এদিকে আমার এক বেহেন এর বাড়ি আছে, সেখানেই...'

'তো এতটা পথ এসে আপনি রেস্ট না নিয়ে ঘটে এলেন যে?'

'ওখানে সব জিনিসপত্তর রেখে, চলে এলাম। যা গরম। ভাবলাম সামনে গঙ্গার ঘাট, হাওয়া টাওয়া দিলে না হয় এক রাত এখানেই শুয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।'

'তা যা বলেছেন, এবারে একদম অসহ্য গরম পড়েছে, তাও ঠিকঠাক গরমকাল নয় এখন'

'তা দাদা, আপনি এত রাতে এখানে? আশেপাশেই থাকেন বুঝি?'

'হ্যাঁ, ওই আপনারই মত। হাওয়া খেতে চলে এসেছিলাম। এই এবার উঠব' একটা হাই তোলার ভঙ্গি করে অর্ক।

ধূপটা আছে লোকটার ঠিক পাশে। ঘরে আর ধূপ নেই, রাতে মশা কামড়াতে পারে। কিন্তু লোকটা তো বলছে এখানে নাকি সে থাকবে সারারাত। থাক তবে কয়েল টা, ওনার কাজে লেগে যাবে।

'দাদা চলি' রাস্তার দিকে একধাপ করে উঠে আসতে থাকে অর্ক। লালু কে দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে, কমপ্লেক্সের সামনে শুয়ে আছে হয়তো, ওখানে গেলেই লেজ নাড়বে আবার। লালুর চিকেন চাউতে অরুচি হবে না আশা করা যায়।

'দাদা আপনার চাবি। চাবি টা পড়ে গেছে এখানে'

চট করে পকেটে হাত চলে যায়। নাহ্, চাবি নেই। ছিঃ কি যে হচ্ছে আজকে। এরকম কেয়ারলেস তো নয়। ওই বিড়ির প্যাকেট বের করতে গিয়েই হয়েছে। বারমুডা গুলোর পকেট ছোট্ট হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন। দৌড়ে ফিরে আসে অর্ক। লোকটা সেই একই জায়গায় বসে, ঘাটের অন্ধকার দিকটায়। অর্ক চাবি টা তুলে নেয়।

'ধন্যবাদ দাদা, ওই বিড়ির প্যাকেট...'

'না না, আমায় শুক্রিয়া বলে কি হবে, একটু বাদে আপনি নিজেই ফিরে আসতেন এটা খুঁজতে'

'হ্যাঁ, তাও আর কি' 'সিগারেট চলবে?' অর্ক একটা মার্লবোরো বাড়িয়ে দেয় রামবিলাসের দিকে। বেশ কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতার পর অন্ধকার থেকে এক শীর্ণকায় হাত বেরিয়ে এসে যত্নের সাথে সিগারেট টা নিয়ে নেয় ওর কাছ থেকে। একটু তফাতে নিজের সিগারেটটা ধরিয়ে বসে পড়ে অর্ক।

'একি! ধরালেন না?' বিড়ির গন্ধ নাকে আসতেই মুখ ফসকে বলে ফেলে অর্ক।

'না মানে... ইয়ে, বিড়িটা খেয়ে নি। আসলে খুব একটা তো খাই না সিগারেট। পরে খাব বলে...'

হো হো করে হেসে ওঠে অর্ক 'আমি ও করতাম দাদা এরকম জানেন? কলেজ এ ছিলাম যখন'

আশুতোষের সেকেন্ড ইয়ারের কথা মনে পড়ে অর্কর। মিলির দেওয়া প্রথম ডানহিলটাই তো বুক পকেটে ঢুকিয়েছিল সরাসরি। সেটা যে কি করে মিলি দেখে ফেলেছিল ধরতে পারেনি ও। ওর পরের জন্মদিনে একটা আস্ত ডানহিলের প্যাকেট গিফ্ট করেছিলো মিলি। সে কি প্রচণ্ড লজ্জার ব্যাপার।

'আবার এসে বসলেন যে? ঘুমোবেন না?' সাময়িক অস্বস্তি কাটিয়ে প্রশ্ন করে রামবিলাস।

'নাহ্ সেরকম ঘুম নেই চোখে। আপনি বলুন... এই অবস্থায় হঠাৎ বোনের বাড়ি? মানে খুব দরকারি কিছু নাকি?' ভুল বুঝতে পারে অর্ক 'মানে আর কি... আপনার যদি বলতে কোনো আপত্তি না থাকে তবেই...'

'না না প্রবলেম এর আর কি আছে'

রামবিলাসের বিড়ির ধোঁয়ার কুন্ডুলী অনুসরণ করতে গিয়ে অর্ক বুঝতে পারে যে সেই নেশার দল টা আর নেই। হয় কেটে পড়েছে আস্তে আস্তে অথবা ওখানেই নির্জীবের মত পড়ে রয়েছে। গাঁজার গন্ধটাও নেই আর।

'একটা ওষুধ নিতে এসেছি দাদা'

'ওষুধ?'

'হ্যাঁ, রাম দিয়েই কি বেশ নাম... রামদেশ না ওরকম কিছু, লেখা আছে আমার কাছে' 'আমার নামের সাথে মিল আছে ওষুধটার' ওই অন্ধকারেও রামবিলাসের সাদা দাঁত গুলো দেখা যায় ক্ষণিকের জন্য।

অর্ক বুঝতে পারে, ওষুধ টা রেমডেসিভির।

'আপনি এতদূর এলেন? কার লাগবে এটা?'

'আমার মেয়ের দাদা' গলা ধরে আসে রামবিলাসের 'ডাক্তার বলেছেন, এই ওষুধ টা আনলে মেয়েকে বাঁচানো গেলেও যেতে পারে। মালদাতে একজনের সাথে কথা হলো ফোনে, গেলাম কিন্তু কিছুই পেলাম না। সব ওষুধ নাকি শেষ। সেখানেই আরেকজনের নাম্বার পেলাম, তাকে কুড়ি হাজার টাকা পাঠিয়েও দিয়েছি। তারপর উনি বললেন নাকি কলকাতা এসে নিয়ে যেতে হবে। ঝামেলা করলে আরো দেরি হয়ে যাবে ভেবেই আর কিছু বলিনি। সঙ্গে সঙ্গে চলে এলাম কলকাতা'

'আপনি কুড়ি হাজার টাকা পাঠিয়েছেন? কাকে?' প্রায় চিৎকার করে ওঠে অর্ক 'আপনি জানেন তারা কারা? লাইসেন্স আছে কিনা তাদের?'

'হ্যাঁ মানে... আমাদেরই ওখানকার একটা ছেলে, কারানজিত্। ওরই চেনাজানা লোক। ওকেই তো আমি টাকা টা দিয়েছি, আর ও নাকি ফোন দিয়ে টাকা টা পাঠিয়ে দিয়েছে তাকে'

অর্ক একটা বিরাট বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। লোকটাকে ও কি করে বোঝাবে যে ওনাকে হয়তো ঠকানো হয়েছে।

'আপনাকে কোনো বিল দিয়েছে? বা কোনো ঠিকানা?'

'হ্যাঁ, সিটি সেন্টার বলে একটা জায়গার নাম দিয়েছে'

'আপনি কি কাল যাবেন সেখানে?'

'হ্যাঁ দাদা সেইরকমই তো ভেবেছি'

আবার দীর্ঘশ্বাস পড়ে অর্কর। কাল থেকে লকডাউন, মেট্রো, বাস, ট্রেন সবই তো প্রায় বন্ধ। আর ই-পাস ছাড়া যাতায়াত করতে অসুবিধা হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা এই পুরো জিনিসটাই তো ভুয়ো মনে হচ্ছে।

'আপনি ফিরবেন কিভাবে?'

'ওই কালকেই কলকাতা থেকে লাস্ট বাস ছাড়বে, সন্ধ্যেবেলা'

যাক, তাও প্ল্যান আছে একটা।

'আপনি কি ভাবছেন আমি জানি। বউ কে তো বাঁচাতে পারলাম না, তাইই হয়তো খুব তাড়াহুড়ো করে টাকা টা পাঠিয়ে দিয়েছি। ওষুধটা না পেলে ও কালকেই ফিরতে হবে, আর কোনো উপায় নেই'

'আপনার স্ত্রী...'

'আমরা বাল্লিয়ার লোক আসলে। একমাস আগে দীপ্তির করোনা ধরা পড়লো। হসপিটালে বেড পেতে লাগলো এক সপ্তাহ। সেখানেও ডাক্তার বললো অক্সিজেন আনতে হবে বাইরে থেকে'

একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলো অর্কর শিরদাঁড়া দিয়ে।

'অনেক খুঁজলাম দাদা জানেন, পেলাম না। তিনদিনের দিন পেলাম, কিন্তু ততক্ষণে আর...'

কাঁপা হাতে মার্লবোরো টা ফেলে বিড়ি ধারালো অর্ক। লোকটা নিজের মনে বলে যাচ্ছে। সে হয়তো লক্ষ্য করেনি গঙ্গার এই স্নিগ্ধ হাওয়া তেও হঠাৎ করে কি অস্বাভাবিক রকমের ঘামছে অর্ক। কিন্তু অর্কই বা কি করবে! খেয়ে পড়ে তো বাঁচতে হবে না কি রে বাবা। সামনেই বাবার অপারেশন। হাঁটু দুটো নিয়ে বড্ড ভুগছেন ভদ্রলোক। কলকাতায় একটা ভালো ফ্ল্যাট এর যে এরকম আকাশছোঁয়া দাম, সেটাই বা কি ও আন্দাজ করতে পেরেছিল নাকি? আর সেই আদ্যিকালের সেকেন্ড হ্যান্ড ডিসকভার টাও আর চলছে না। তেলের থেকে মেনটেনেন্স খরচ বেশি। ছোট্টবেলা থেকে ক্লাসে ক্লাসে পড়ানো হচ্ছে 'সারভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট', সিনেমা তে দেখানো হচ্ছে 'লাইফ ইজ আ রেস' আর বাস্তবে সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেই খারাপ লোক? এ জগতে টাকার থেকে বড় কিছু হয় না। প্রতি মাসে বাড়ি টাকা পাঠানো আর চোদ্দ রকমের ইএমআই দেওয়ার পর জমে আর কতটুকু? অর্ক স্বপ্ন দেখতে জানে কিন্তু দেখলেই তো হয় না, তার পেছনে লেগে থাকতে হয় অনবরত। এ সমাজে সুযোগ আসে না, আর এলে সেটাকে ছিনিয়ে নিতে জানতে হয়। এতে দোষের কি আছে?

'তাও মাসুদ ভাই ছাড়া আর কেউ দিতেই চায়নি। তাও, সেদিন রাতটাও পুরোটা পেরোতে পারলো না পূজার মা' 'ওকে আর ফেরত ও দিলো না আমাদের কাছে, একটা প্লাস্টিকে মুড়ে কিভাবে...' রামবিলাস থামে।

অর্ক কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না, গলা শুকিয়ে গেছে। ওদের অজান্তেই যেনো ঘাটের চারপাশে কেমন একটা অতিজাগতিক নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। গঙ্গার ঠিক উল্টো দিকে প্রতিদিনের মতো আজকেও এতক্ষণ অবধি একটা লাল আলো দপ দপ করছিলো, কোনো কারখানা বা টাওয়ার হবে হয়তো। অর্ক লক্ষ্য করলো সেটা আর জ্বলছে না, নিভে গেছে সম্পূর্ণ।

'চারদিন কিচ্ছু মুখে তুললো না পূজা' 'ওর ও শরীর খারাপ লাগা শুরু করলো দিন দশেক বাদে। টেস্ট করানো হল। রিপোর্ট এলো আরো চারদিন বাদে। ততদিনে আর জমানো বলতে আর কিছুই ছিলোনা বুঝলেন কিনা, এদিকে ওদিকে সব খরচ হয়ে গেছে'

অর্ক এখনো সেই আলো টা খুঁজে বেড়াচ্ছে, এভাবে একটানা কখনো তো বন্ধ থাকে না।

'জমি বন্ধক রাখলাম, পূজা কে হসপিটালে ভর্তি করাতে কোনো বিশেষ অসুবিধা হল না এবার, অক্সিজেন ও পেয়ে গেলাম সহজেই। সেই মাসুদ ভাইয়ের কাছ থেকেই' মুখ দিয়ে একটা চুক্ চুক্ আওয়াজ করে রামবিলাস 'ওনাকে এখনো অক্সিজেনের টাকা টা দেওয়া বাকি'

অর্কর বিবেক সশব্দে ফেটে পড়ে এবার। মিলির সাথে এই নিয়েই বেশ কয়েকদিন ধরে ঝগড়া চলছে। ওর কোন একটা রেড ভলেন্টিয়ার বন্ধু, অভিষেক না কি বেশ নাম, তাকে মিলি অর্কর নাম্বার টা দিয়েছিলো অক্সিজেনের লিড হিসেবে। মিলি জানতো না এরকম চড়া দামে অক্সিজেন বিক্রি করছে অর্করা। ছেলেটা গিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই অর্কর পছন্দ নয় ছেলেটিকে। বড্ড পিরিত মিলির সাথে। ওকে দেখলেই বিরক্ত লাগে অর্কর। শুধু কপচানি। সারাদিন তো ওই গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে ইউনিভার্সিটির মাঠে। মিলি এই বেশি দামে অক্সিজেনের কেস টা জানার পর থেকেই খুব ঝামেলা করছে। সোনার চামচ মুখে করে জন্মালে কি আর এত সহজে বোঝা যায় টাকার মর্ম? আর অর্ক যে মানুষ কে সাহায্য টাহায্য করে না তা তো একেবারেই নয়। এই তো সেদিন রক্ত দিয়ে এলো। সেখানেও সেই মিলিই টেনেটুনে নিয়ে গেছিল, কিন্তু অর্ক গেছিল তো! অর্কর বোম্বে ব্লাড গ্রুপ, খুব কম লোকের থাকে। তাই ডোনেশান সার্টিফিকেটটা যে এই 'সাহায্য' করার একটা কারণ নয়, তা জোর গলায় দাবি করা যায় না বটে। তবে ওর নাম্বার বেশ কয়েকটা এনজিও তে দেওয়া আছে, মাঝে মাঝে তারাই ডাকে রক্ত দেওয়ার জন্যে। বছরে অন্তত দুবার করে রক্ত দেয় অর্ক। আর এই যে সেদিন, কোভিড ভলেন্টিয়ারদের জন্য পাড়ার ক্লাব থেকে পিপিই কিট, অক্সিমিটার, মাস্ক আরো কত কিছু দান করা হল, সেখানে কি অর্কর অনুদান কম ছিল নাকি?

'দাদা কি হল? ঠিক আছেন আপনি?'

'হ্যাঁ হ্যাঁ, এইতো... একদম' জামার হাতায় কপালের ঘাম মুছে নিজেকে একটু সামলে নেয় অর্ক।

'আপনি এলেন হাওয়া খেতে এর আমি এইসব বলে আপনাকে বিরক্ত করছি' 'ছিঃ ছিঃ'

'না না একি, বিরক্ত কেনো হব... আচ্ছা শুনুন না রামবিলাস বাবু, আমার এক পরিচিত আছেন যার কাছে এই ওষুধ টা থাকতে পারে বুঝলেন? তো কাল সকাল সকাল আমি তাকে একটু ফোন করে দেখে নেবো না হয়'

পুনরায় রামবিলাসের দাঁত গুলো চকচক করতে দেখা যায় অন্ধকারে। সে কিছু বলে উঠতে পারে না।

'কিন্তু তার আগে আমার একটু পেশেন্ট ডিটেইলস্ টা লাগবে যে'

রামবিলাস এবার ও কি বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না।

'আচ্ছা, আপনি বেরোবেন কখন কাল?'

'সেতো কিছু ঠিক করিনি, তবে আটটার বেশি দেরি তো করা যাবে না'

'আমি আটটায় এই ঘাটে দাঁড়াব, আপনি ডাক্তারের দেওয়া কাগজপত্র আনবেন, আমি দেখে নেবো যা লাগবে'

'আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো? আপনার সাথে এভাবে দেখা হওয়াটাও এই গঙ্গা মাঈ এর কৃপা' রামবিলাস মুখটা এবার একটু আলোর দিকে আসে। মুখটা আবছা দেখতে পায় অর্ক।

হলুদ কলারের ওপর যেনো একটা চৌকো বাক্স বসানো। ঘন গোঁফ, চওড়া চোয়াল ভর্তি খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি, চোখের তলায় কালি আর চোখ দুটো লালচে। ঘুমের অভাবটা চোখে মুখে স্পষ্ট।

'দীপ্তি ও বেঁচে যেতো জানেন, বেসরকারি হাসপাতালে রাখতে পারলেই বেঁচে যেতো' হলুদ আলোয় ওর চোখের কোণ টা চিকচিক করে ওঠে।

অর্কর অস্বস্তিবোধ আবার ফিরে আসে। অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল যে কিভাবে ডাকাতি করছে সেটা রামবিলাস আর কি করে জানবেন। আরো এক স্তর বিষন্নতা যাপটে ধরে অর্ককে। মিলির বাবা মাকেই ধরা যাক। লাখ লাখ টাকা লুটছে স্বামী স্ত্রী মিলে। মিলি কিছুই জানতো না কাল অবধি। অর্ক জানে বহুদিন কিন্তু মিলিকে কিছুতেই বলে উঠতে পারেনি আজকের আগে। রাগের মাথায় 'আগে নিজের বাড়ির খোঁজ নিয়ে দেখ, কিভাবে কি চলছে চারদিকে। চোখ টা মেলে একটু তাকা। আমি ধর্মাবতার নই, সেরকম দাবি ও করিনি কখনো। কিন্তু তোর এই নিজের বাবা মা কে কিচ্ছু না বলে শুধু আমার পেছনে লেগে থাকাটা বিরাট বড় হিপোক্রিসি।' এইসব ছাইপাঁশ বলে ফেলেছিল ফোনে। পাক্কা এক মিনিট মিলি একটা কথাও বলেনি। তার পরেই ফোন টা কেটে দেয় অর্ক। এখন খারাপ লাগছে। অনুশোচনায় গা গুলিয়ে উঠছে। কি বোকার মত কাজ করেছে। ছিঃ। অর্ক উঠে দাঁড়ায়, এবার ফিরতে হবে।

'উঠলেন?'

'হ্যাঁ?' বাস্তবে ফিরে আসে অর্ক, 'হ্যাঁ দাদা উঠি। ওই কথাই রইলো তাহলে কাল সকাল আটটায় দাঁড়াবেন। আমি দেখছি কি করা যায়।' 'আজ আসি তবে, অনেক রাত হলো।'

রামবিলাস কিছু বলেন না, কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বুকপকেট থেকে মার্লবোরো টা বের করেন।

পকেটের জিনিসপত্র চেক করতে করতে অর্ক আর এটা চেপে রাখতে পারে না 'আচ্ছা রামবিলাস বাবু, আপনি তো ইউপির লোক, এত সুন্দর বাংলা শিখলেন কোথায়?'

ফিক ফিক করে হেসে ধরা গলায় রামবিলাস বলে ওঠেন 'ওটা না হয় কাল বলি... হেহে'

অর্কর ঘুম ভাঙল দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে। ঘুম চোখে দরজা খুলে দেখে সামনে মিলি দাঁড়িয়ে। একি অবস্থা মেয়েটার, চোখ মুখের কি হাল। কাল রাতে মিলি ঘুমোয়নি, বাড়িতে ঝামেলা হওয়াও আশ্চর্য নয়। ছিঃ কাল ওরকম অভদ্রের মত কথা বলা উচিত হয়নি।
অর্কর বগলের তলা দিয়ে ঘরে ঢুকে মাস্ক, ব্যাগ রেখে, স্যানিটাইজ করার পরই মিলির চোখ যায় চাউমিনের প্যাক করা বাক্সটার দিকে। অর্কর দিকে একটা ভস্ম করে দেওয়া দৃষ্টি দিয়ে ওটা নিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে মিলি। এভাবে মিলি আবির্ভাব হবে এটা আশা করেনি অর্ক। মুখটা বিস্বাদ হয়ে আছে অনেকক্ষণ কিছু না খাওয়ার জন্যে। ঘড়িতে চোখ পড়তে আঁতকে ওঠে ও। ছোটো কাঁটা নয়ের ঘরে আর বড় কাঁটা বারো ছুঁইছুঁই।

'মিলি দু মিনিট বস, আসছি... খুব দরকারি' কোনোরকমে মুখে মাস্ক টা গলিয়ে নিমেষের মধ্যে সিঁড়ি ভেঙে, গেট পেরিয়ে রাস্তায় আসে অর্ক।

একি পুলিশের গাড়ি কেনো? তাও আবার দু দুটো। সকাল দশটা অবধি তো বাজার খোলা, এখন টহল দেওয়ার মানে কি? গঙ্গার ঘাটে বিরাট বড় জটলা দেখে সন্দেহটা গাড় হয়, নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে এখানে। একদম শুরুতেই একজন অফিসারকে ঘিরে ভিড়। সোশাল ডিসট্যান্সিং এখন একটা তামাশার পর্যায়ে নেমে এসেছে। তাও বেশিরভাগের মুখে যে মাস্ক আছে এটাই অনেক।

'আপনি ওদের হাত দিতে দিচ্ছেন কেনো?'

'আজব তো মশাই, আমি হাত দিতে না দেওয়ার কে?'

'আপনি পুলিশ। নিজের কাজটুকু ঠিকভাবে করুন'

'আরে জ্যেঠু, আমরা আসার আগেই তো ওরা...'

'তা বলে আপনারা থাকাকালীন ও সেটাই চলতে থাকুক নাকি?'

পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে পুলিশের ক্যাঁচরম্যাচর কে বাঁ হাতে রেখে কয়েকটা ধাপ নেমে যায় অর্ক।ওই তো পিন্টু

'পিন্টু, এই পিন্টু... এদিকে আয়'

পিন্টু অর্কর থেকে একটু ছোটো, এ পাড়াতেই আলাপ। ক্লাব এ একসাথে নিয়মিত তাস খেলত ওরা।

'কি হয়েছে রে?'

'আরে, আর বোলো না অর্কদা। আজ সকাল আটটা নাগাদ নাকি বিশু ওই পাশের ঝোপে একটা সাদা বস্তা আটকে থাকতে দেখেছে'

'বিশু মানে আমাদের ক্লাবের...'

'হ্যাঁ ওই বিশুর কথাই বলছি, ও প্রতিদিন স্নান করতে আসে তো সকালে। ওই তো দেখো না, আধ ঘণ্টা ধরে ওখানে দাঁড়িয়ে ফুটেজ নিচ্ছে'

অর্ক দেখলো একটু দূরে দুজন কনস্টেবলের সামনে দাঁড়িয়ে বিশু অঙ্গভঙ্গি করে এদিকে ওদিকে হাত ঘুরিয়ে কি সব বোঝাচ্ছে।

'এই এটা এবার চললো, পুরো বরানগরে ঢাক পেটাতে বেরোবে এবার, বিশু শিকদার গঙ্গায় মরা আবিষ্কার করেছে'

অর্কর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি কে পিন্টু এড়াতে পারে না 'আরে ওই উত্তরপ্রদেশের কেস টা গো। গঙ্গায় কোভিড বডি ফেলেছে। মালদাতে এসে গেছিল তো অনেকগুলো। ওখানেই সব তুলে নেওয়া হয়, এরকম দু একটা হয়তো এদিকে ওদিকে মিস হয়ে গেছে।'

'তো এরকম একটা বডি, কেউ খুলেছে নাকি? ওপরে সাধন জ্যেঠু চেঁচাচ্ছেন শুনলাম'

'না খোলেনি, তবে খুলতে যাচ্ছিলো। তাদের আটকানো হয়েছে। ওরাই ঘাটের শেষ ধাপটায় এনে রেখেছে, ওই তো দেখো না'

'আচ্ছা আমি যাই, বলছি শোন না এদিকে রামবিলাস নামের কারুর খোঁজ পেলে বলিস তো, কাল রাতেই এসেছে পাড়ায়। খুব জরুরী ভাই, জানাস কিন্তু'

পিন্টুর আশ্বাস পেয়েও একটু মন খারাপ নিয়েই এক ধাপ উঠে এসে থমকে দাঁড়ায় অর্ক। একটা টাটকা মার্লবোরো। একি নামার সময়ে তো এটা চোখে পড়েনি। কারুর পকেট থেকে পড়া ও সম্ভব নয়, ওদের পেছনে তো কেউ ছিল না একটু আগেও। সিগারেট টা এখনো দিব্যি শুকনো, কিন্তু সিঁড়িটা তো ভিজে। সিগারেটের সাদা জায়গায় একটুও কাদা লাগেনি। আচ্ছা এই ধাপেই কালকে ওরা বসেছিল না? হঠাৎ করে বুক টা একটু কেঁপে ওঠে অর্কর।

বডির কাছে দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছেন বটে কিন্তু লোকজনের উৎসাহের কাছে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চলেছে। তারাও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। অর্ক সেদিকে এগিয়ে যেতেই মালতী কাকিমা ওকে ধরে ফেলেন।

'যেও না বাবা, লোকটার মুখের মাস্ক টা সরে গেছে, কি বীভৎস দৃশ্য... দেখা যায় না'

অর্ক অনুমান করে, ওটা বস্তা নয়। ওটা বডি ব্যাগ হতে পারে যেগুলোর ওপরের দিকের কিছুটা অংশ স্বচ্ছ থাকে।

'না না কাকিমা, এই আর কি… একটু বিশুর কাছে যাব' সুনিপুণ দক্ষতায় পাশ কাটিয়ে শেষ ধাপে ভিড়ের মধ্যে পা রাখে অর্ক।

মুহুর্তের মধ্যে ছিটকে আসে অর্ক। প্রচণ্ড গা গোলাচ্ছে। ওই মুখ তো তার চেনা, সেই এক গোঁফ, সেই চওড়া চোয়াল... এ হতেই পারে না। ওখানেই বসে পড়ে অর্ক।

'এই কি হল রে?' 'ধর ধর'

পিন্টুরাই টেনে তুলে একটু পাশে নিয়ে যায় তাকে। অর্কর চোখ বিস্ফারিত, দর দর করে ঘামছে অর্ক। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কাল রাতেই তো... বাঁ হাতের মার্লবোরোটা একরকম ভয় পেয়েই ছুঁড়ে ফেলে দেয় গঙ্গায়।

'আরে আরে ওটা ফেলছ কেনো!'

কোনোক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে পিন্টুকে উপেক্ষা করে অর্ক ছুট দেয় ওর ফ্ল্যাট এর দিকে। কেউ বিশ্বাস করবে না ওকে। ও নিজে হলেও করত না। তাও যদি কেউ করে, সেটা মিলি। মিলি কোথায়? ওকে খুলে বলতে হবে সবটা। আর হ্যাঁ, আজ শোভনদা কে ফোন করাটা বিশেষ দরকার।

Post a Comment

0 Comments