কৃষ্ণকলির আরশি...

কৃষ্ণকলির আরশি...


'থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়' র জীবনে অভ্যাসবশত ঘুম ভাঙলো বরাবরের মতো ভোরেই। সূর্যের প্রথম রশ্মিকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম হয়তো অবচেতনে, তাই সেও  প্রথম আলো চেতনে  নিয়ে এসে আমার ঘুম ভাঙায় সোনার কাঠির জাদুতে। মুঠোফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি ভোর ৫:০০ টা। ভোরের হালকা আমেজে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছিলো না। তাই কি আর করি, শ্রবণযন্ত্রটি দ্বিতীয় ইন্দ্রিয়ে দিয়ে দূরের তারাবিহীন নরম,কোমল স্নিগ্ধতায় ভরা সূর্যের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এই সময় কতো না মানব সন্তান,
  'ওং জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ‍্যপেয়ং মহাদ‍্যুতিম
     ধান্তারীং সর্বপাপঘ্নং প্ৰণতোহস্মি দিবাকরম্।'
প্রণামমন্ত্রে ব্যস্ত। আর হবে নাই বা কেনো? সূর্য দেবতা যে! আঁধার কেটে চারিদিক আলোকিত করতে একমাত্র এই  তো পারে,তাই তাকে পুজো না করে উপায় কি ? কিন্তু, আমি তো পুজো করিনা আমি যে তাকে ভালোবাসি।  কেনো বাসি, তা নয় বলবো খন পরে কোনো সময়। আসলে,জীবনের প্রতিটি মন প্রাণ স্পর্শ করার শুভ মুহূর্তগুলি কেটেছে এমনই  আবীরে রাঙানো প্রহরে। তা সে গোধূলীবেলাই হোক আর ব্রাহ্ম মুহূর্তেই হোক।   
           টুং করে আওয়াজে দেখি আমার ছোট্ট বোন পাঠিয়েছে আমাকে এমন এক রত্ন যা আমার অনুভবে চলে যাওয়া সময়। আর সেই সময় যে কতো সুন্দর তা উপলব্ধি করা যায় ফেলে আসার পরই। আমার দিদার আরশি। আসল বার্মিজ সেগুন কাঠের তৈরি। কথাশিল্পী শরৎবাবু তাঁর 'পথের দাবি' এবং 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসে রেঙ্গুন শহর ও বার্মার সম্পদের কথা  যেভাবে বর্ণনা দিয়ে গেছেন তা সবাই জানে তাই নতুন করে বার্মাটিক বা বার্মা সেগুন কাঠ নিয়ে আলোচনায় গেলাম না। চমৎকার জিনিস।  এককথায়, যাকে Antique বলে। চৌকো ফ্রেমের মধ্যে একটা কাঁচ লাগানো। কাঠের ফ্রেমটা দুপাশে দুটো স্ট‍্যাণ্ডের সাথে আটকানো। এমনভাবে আটকানো যাতে আয়নাটা দোলে। দোলনা আয়না। কালো কাঠের হাতল  লাগানো ড্রয়ার। আর সেই ড্রয়ারে থাকতো গুপ্তধন। আজ সেই গুপ্তধনের সন্ধানে তোলপাড় হলো আমার ফেলে আসা  ভাবনা,আমার মতো। ড্রয়ারের ওপর পাতা থাকতো কুরুশের কাজ করা একটি ছোট্ট টেবিলক্লথ। ড্রয়ারে থাকতো খোঁপার কাঁটা,সিঁদুর কৌটো, পাউডার,নরম ভেলভেটের শিশিতে শোয়ানো সেন্ট, আমার কাজল, আমার কুমকুমের টিপের বাক্স। শৃঙ্গারের কুমকুম। লাল,নীল, হলুদ,সবুজ,কতো রঙ ! কাঠি ডুবিয়ে ডুবিয়ে পরতাম, কি সুন্দর গন্ধ তাতে ছিলো। আর থাকতো এমন এক জিনিস যা ছিলো আমার সব থেকে প্রিয়। বসন্তমালতী। যার কাছে এই যুগই নয় শুধু আগামী বহু যুগের ক্রিম হয়তো হার মেনে যাবে। বসন্তমালতীর গোলাপি কৌটোর ঢাকনা খুললেই আসতো আমার দিদার গায়ের গন্ধ। আমার দিদা ছিলো ধবধবে ফরসা রঙের,আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা, পানের রসে ডোবানো ঠোঁট দুটো লাল,কাঁচাপাকা খোলাচুল একপিঠ। সদা সর্বদা কাজে ব্যস্ত। দিদার ওই মোহিত করা রূপের জ্যোতিতে আজও হার মানে আমার ড্রেসিংটেবিল ভরা ক্রিমের কৌটোর দাপট।
             দিদা ছিলো আমার ভারী বুদ্ধিমতী।খুব অল্প বয়েসেই বিয়ে হলেও নিজের সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখতে জানতো। আমি ছিলাম মামারবাড়িতে মানুষ,কিন্তু দিদার খুব কাছের জন ছিলাম। সে পাকা চুল বেছে দেওয়া হোক,আম কুড়োনো হোক, আচার রোদে দেওয়া হোক,চা করা হোক বা পান সাজাই হোক। দিদা খুব ভালোবাসতো আমার হাতের চা, আর  ভালোবাসা ছিলো আমার হাতের  সাজা  পান খেতে। দিদা বলতো, 'জানিস, যার হাতে চা আর পান সাজা সুন্দর হয় তার হাতের রান্নাও সুন্দর হয়।' আমি বলতাম, 'রাঁধতেই তো জানি না ,তাহলে সুন্দর হবে কি করে?' দিদা বলতো,'সে সময় বলবে ঠিক। তখন দেখবি আমি হয়তো থাকবো না।'  আমি বলতাম,'না গো, তোমাকে তো আমি নিয়ে চলে যাবো।' সে স্বপ্ন আমার  স্বপ্নই থেকে গেলো।
                       আমার গায়ের রঙ কালো বলে আমার মায়ের দুঃখ ছিলো। মা আমার ফর্সা, সুন্দরী কিন্তু আমি আমার বাবার মতো। যথানিয়মে চলতো আমাকে সর, ময়দা, কাঁচা হলুদ, বেসন আরও কতো কি মাখানো। কালো রঙ হওয়ার ফলে দুঃখ আমারও যে ছিলো না তা নয় ; আর দুঃখ করলেই  দিদা বলতো,
  'কালো, জগতের আলো।  কৃষ্ণও যে কালো কিন্তু সে যে জগতের আলো। দেখবি, এই কালো রঙেই তুই একদিন আলো হয়ে উঠবি সবার মাঝে।'  আমি বলতাম, 'দিদা আমি যে অতি সাধারণ। আমার আবার আলো কি ?' দিদা বলতো ,'মাগো, সে তো সময় বলবে। আমার আশীর্বাদ মিথ্যে যাবে না।'  একাল সেকালের  মাঝে দাঁড়িয়ে আজ মনে হয় দিদার আশীর্বাদ ফলে গেছে। আমার ঠাকুর অর্থাৎ  রবি ঠাকুরের সাথে আমার প্রথম পরিচয় করিয়েছিলো আমার দিদা। কিশোরীবেলায়  প্রথম কাজল পরা আমার, দিদার ওই আয়নায়। আর সেই কাজল ঘেঁটে গিয়ে নিজের গায়ের রঙের সাথে  যখন মিশে যেতো খুব কাঁদতাম আমি। আর দিদা বলতো পিছন থেকে ওই আয়নায় আমার  প্রতিবিম্ব দেখে,
   "কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক ।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে, কালো মেয়ের কালো হরিণ -চোখ..."
    তুই তো রবি ঠাকুরের কৃষ্ণকলি, দুঃখ করিস কেনো কালো রঙ নিয়ে ? রবি ঠাকুর যে তোর জন্য কবিতা লিখেছে।"  আমি বলতাম,' রবি ঠাকুর কে গো ? সে আমাকে চিনলো কি করে ?  আমাকে বুঝি নাম দিয়েছে ?'  দিদা বলতো, "সে যে সবাইকে চেনে কারণ সবাইকে সে তার অন্তরাত্মা থেকে চেনে।" কিছুই না বুঝে ঘাড় নেড়েছিলাম কিন্তু খুব ভালো লেগেছিলো যে আমার কালো রঙ তবে ভালো, কেউ তো কবিতা লিখলো আমার কালো রঙ নিয়ে। আমাকে আবার কেউ নাম দিলো,'কৃষ্ণকলি'। মন আনন্দে খুশিতে ঝলমল করে উঠেছিলো। যতবারই ওই আয়নায় মুখ দেখতাম কাজল পরতাম,টিপ পরতাম, রোজকার চেনা মুখ,এক অপূর্ব সৌন্দর্যের প্রভায় ফুটে উঠতো। এক আলো এসে পড়তো  যেনো মুখের ওপর।
           পূর্ণ দৃষ্টিতে সূর্যের আলো কোমলতা, স্নিগ্ধতা ছেড়ে কখন যে  কঠিন কঠোর হয়েছে খেয়ালই করিনি স্মৃতির পথে হাঁটতে হাঁটতে 'কৃষ্ণকলি' নামক  অস্তিত্বের ভালোবাসায়। শৈশব , কিশোরীবেলা, যৌবন ছাড়িয়ে বয়েস এখন এগিয়ে চলেছে বেলাশেষের দিকে। মুঠোফোনের ছবির ভেতর দিয়ে আবার ইচ্ছে করলো আয়নায় নিজেকে দেখতে। জানিনা, কোন অজানা পথে সেই আয়নার কাঁচে আলো এসে পড়লো আর নিজের মুখখানা আবারও সেই আলোর প্রভায় আলোকিত হয়ে উঠতে দেখলাম। দিদা বলতো,   
                    "আয়নার সামনে দাঁড়ালে বহিরঙ্গ প্রতিফলিত হয়। মনের কথা জানতে গেলে চোখ রাখতে হয় চোখে, তবেই না খানিক আঁচ করা যায় মনের তল !"
               স্মৃতির অতলে হারিয়ে, দিদার 'কৃষ্ণকলি' র মনের তল  মনের গভীরতা ছুঁয়ে গেলো কৃষ্ণকলির আরশিই। খুব কাছের এক লেখকের অনুভূতির কথা মনে পড়ে যায়,
         "মন কেমন করলেই যে ইচ্ছে করে ফিরে যেতে প্রজাপতি বেলায়..."

সুমি ভট্টাচার্য্য


   

Post a Comment

0 Comments