নিত্য সত্যের নিবেদিতা,মায়ের আদরের খুকি...
গুরু শিষ্যার সম্পর্কই হচ্ছে এক অসামান্য সম্পর্ক। আর গুরু শিষ্যা শব্দটি উচ্চারণ করলেই মনে আসে স্বামীজীর অলৌকিক আবিষ্কার ভারতের জন্য : নিত্য সত্যের নিবেদিতা।
আইরিশ তেজস্বিনী নারীকে কি মন্ত্রে যে স্বামীজী সম্পূর্ণ ভারতীয়াতে আদ্যন্ত রূপান্তরিত করেছিলেন ,তা একমাত্র তিনিই জানেন। স্বামীজীর সংস্পর্শে আসার পর থেকেই মিস মার্গারেট নোবেল তাঁর সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে।একটু অতীতের পথে হাঁটলেই দেখতে পাই উত্তর আয়ারল্যান্ডের ধর্মযাজকের কন্যা লন্ডনের চার্চ বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করে হ্যালিফ্যাক্স কলেজে শিক্ষা জীবন শেষ করেন। আর তারপর থেকেই তাঁর শিক্ষিকা রূপে জীবন শুরু। দু বছরের জন্য তিনি কেসউইকের একটি প্রাইভেট স্কুলে পড়ান। এরপর একে একে রেক্সহ্যামে, চেস্টারে,উইম্বলডনে শিক্ষকতা করেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই উইম্বলডনে নিজের 'রাস্কিন স্কুল' উদ্বোধন করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক , অর্থাৎ সমাজের অন্ধকার, অবক্ষয়ের দিক। ব্রিটিশ শাসকের অত্যাচারে শোষিত ভারতের সাধারণ মানুষ। ঠিক সেই সময় লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডে লেডি ইসাবেলের বাড়িতে সদ্য শিকাগো ধর্মমহাসভা থেকে ফিরে আসা স্বামী বিবেকানন্দের একটি ঘরোয়া সভা বসেছিলো। সেখানেই প্রথম সাক্ষাৎ গুরু শিষ্যার। সেই আলোচনা সভায় স্বামীজীর শিক্ষা প্রসঙ্গে তিনি শুনলেন ,"শিক্ষা হচ্ছে মানুষের সেই পূর্ণতার প্রকাশ, যা তাঁর মধ্যে বিদ্যমান।" সেদিন থেকে মিস মার্গারেটকে স্বামীজীর বাণী, কথা যুক্তি,তর্ক ,বিচার, বিশ্লেষণ মুগ্ধতায় ভরিয়েছিলো।
এরপর থেকেই নিবেদিতার বাকি জীবন যেনো অগ্নিশিখা। ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়ি থেকে শুরু সংগ্রামের এক ইতিহাস। তাঁর গুরুর শেখানো পথে--"মানবসেবার পূণ্যব্রতে"। যে দেশ বারে বারে দূত পাঠিয়েছে , যে দেশ মনে করেছে ভারত মানেই অন্ধকার ,কুসংস্কারে ঠাসা তাই তাকে নিজ ধর্মে, সভ্যতায় স্নান করানোর মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলো ; সেই তাঁদেরই মাতৃভূমি থেকে উঠে এসে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেন নিবেদিতা। ধর্মযাজকের মতো পা অবধি ঢাকা শ্বেত শুভ্র গাউন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কোমরে দড়ির মতো পাকানো রিবন ,মাথায় লম্বা চুল---তবে এলায়িত নয়, খোঁপার আকারে বাঁধা। সমস্ত দেহ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সূর্যের তেজ। মুখ সদা সর্বদা প্রসন্নতায় পূর্ণ। পুরুষের বাহির মহল থেকে মহিলার অন্দর মহল পর্যন্ত যিনি আলোচনার কেন্দ্রস্থল,সেই তিনি নিজের তেজ দিয়ে আগলে রাখলেন ভারতের ঐতিহ্য, ধর্ম,কর্ম,সংস্কারকে। ভারত ছিলো তাঁর কাছে আত্মার আত্মীয়, মন্ত্রস্বরূপ। জপমালা হাতে নিয়ে নিবেদিতা জপ করতেন পাঁচ অক্ষরের সেই অমর মন্ত্র। সেই মন্ত্র কোনো দেবদেবীর মন্ত্র নয়। মন্ত্র ছিলো--"ভারতবর্ষ , ভারতবর্ষ ,ভারতবর্ষ"। তাঁকে যাঁরা খুব কাছ থেকে দেখেছে,অর্থাৎ তাঁর ছাত্রীদের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে,পাঁচ অক্ষরের "ভারতবর্ষ" নাম জপের সময় তাঁর মধ্যে এক অদ্ভুত অপূর্ব ভাবান্তর লক্ষিত হতো। রোমাঞ্চিত হতেন তিনি। তাঁর ছাত্রীদের স্মৃতিকথায় আরও জানা যায় যে, তিনি যখন সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন মনে হতো না রক্ত মাংসের অবয়ব, মনে হতো যেনো অগ্নিশিখা। এই ১৬ নম্বর বোস পাড়া লেনের বাড়িতে এককালে যে বাংলার কতো মনীষী এসেছেন, হয় সাধিকার মানবসেবার আকর্ষণে, হয় আমন্ত্রণে অথবা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে। আর এসে শিউরে উঠেছেন এমন আলো বাতাসহীন বাড়ির পরিবেশ দেখে ! খুব সহজ হয়নি হয়তো তাঁর পক্ষেও সুদূর পাশ্চ্যাতের বিলাসিতাকে ছেড়ে এই হতশ্রী বাড়িকে , এই দুঃখ কষ্ট কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ভারতকে আপন বলে ভাবা কিন্তু তাও তিনি করেছিলেন । ১৬ নম্বর বাড়ির প্রতি তাঁর মমতার কথা তিনি একটি পত্রে লিখেছিলেন,
" আমার বাড়িতে একটি আঙিনা আছে। বাড়ির মধ্যে এই জায়গাটি আমার আকাশ ও তারার সঙ্গে মিলনের স্থান। দিনের বেলা এখানে শীতল ছায়া বিছিয়ে থাকে ও রাতে এটি হয়ে ওঠে অসীমের পূজামন্দির..."
প্রথমে ঠিক হয়েছিলো বোসপাড়া লেনের যে বাড়িতে মা থাকেন সেই বাড়িতেই হবে নিবেদিতার আশ্রয়। কিন্তু ,এই প্রচেষ্টায় বাধা দিলো তখনকার কলকাতার গোঁড়ামি। ব্রাহ্মণী সারদা মায়ের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকবে এই ম্লেচ্ছ জাতের মেয়ে! এ তো জাতধর্মের ওপরে আঘাতই নয় সরাসরি সমাজের বিরোধিতা। অথচ এই তথাকথিত সমাজরক্ষকরা জানতেনও না এই বিদেশিনী ম্লেচ্ছ জাতের মেয়েকে সারদা মা নিজের মেয়ের মতন দেখেন। ডাকেন তাঁকে,"আদরের খুকি" বলে। শত ইচ্ছা থাকলেও নিবেদিতা বুঝতে পেরেছিলেন বাধার পরিমাণ বিপুল এবং গুরুর সেবাকার্য এবং নারীশিক্ষা বিষয়ক স্বপ্নকে সাকার করে তুলতে তাঁকে অন্য বাড়ির সন্ধান করতেই হবে। সমগ্র হৃদয় দিয়ে তিনি অনুভব করেছিলেন অজ্ঞ, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন নারীজাতিকে একমাত্র শিক্ষা দানের মাধ্যমে জাগিয়ে তুলেই হবে তাঁর কর্মপ্রবাহের সূচনা। পেলেন মায়ের বাড়ির উল্টোদিকেই ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়ি। বাঙালি সমাজ যখন আস্তে আস্তে গ্রহণ করতে শুরু করলো তাঁকে, তখন তাঁর বাড়িতে কেউ আসলেই তিনি তাঁকে চেয়ারে বসতে দিয়ে নিজে মাটিতে বসতেন।তিনি সম্পূর্ণ রূপে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন মানুষ নির্মাণের কাজে। গুরুর আশীর্বাদ, অনুপ্রেরণায় নিবেদিতা কঠিন পথকে সুগম করলেন।স্বামীজী একবার গুরুভাইদের বলেছিলেন,
"এরপর দেখবি নিবেদিতার কার্যকরী শক্তি। নিবেদিতার প্রাণ অতি মহৎ। তার ভিতর কোথাও প্রতিষ্ঠা, যশ বা মুরুব্বীয়ানা নেই। তার হৃদয় অতি উদার ,পবিত্র। নিবেদিতা প্রাণ দিতে এসেছে। গুরুগিরি করতে আসিনি।"
অবশেষে এলো সেই পুণ্য লগ্ন। ১৬ নম্বর বাড়িতে এলেন স্বয়ং শ্রী মা, তাঁর গুরুদেব স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী সারদানন্দ। প্রথাগত পূজাপাঠ শেষ করে সারদা মা মৃদু ভাষায় উচ্চারণ করলেন আশীর্বানী,
"আমি প্রার্থনা করি এই বিদ্যালয়ের ওপর জগণ্মাতার আশীর্বাদ বর্ষিত হোক। এখান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েরা আদর্শ কন্যা হয়ে উঠুক।"
নিবেদিতা তাঁর স্কুলের নাম দিলেন 'রামকৃষ্ণ স্কুল ফর গার্লস' ; যা লোকমুখে প্রচারিত হলো সিস্টারের স্কুল। সংস্কারে আচ্ছন্ন কলকাতার মানুষ জেনে গেলো এই বিদেশিনী স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা--ভগিনী নিবেদিতা। হিন্দু ধর্মের 'Tolerance' ও 'Acceptance' এর চিরসত্যকে তিনি বিদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠা দিয়ে এসেছেন, সেই বিদেশ থেকেই তিনি এনেছেন এই 'সিংহীনি' কে,এই দেশের সেবাব্রত সম্পাদনের জন্য। উইম্বলডনের এই শিক্ষিকা মার্গারেটকে তিনি একবার চিঠিতে লিখেছিলেন,
"এ দেশে যে কি কুসংস্কার, কি দুঃখ,কি দাসত্ব ---তা তুমি কল্পনাতেও আনতে পারবে না।জাতি ও স্পর্শ সম্বন্ধে উদ্ভট ধারণা। শ্বেতাঙ্গরা মনে করবে তোমার মাথা খারাপ। ওরা তোমার গতিবিধি সন্দেহের চোখে দেখবে। তা ছাড়া দারুন গরম। আমাদের দেশের শীতকাল তোমাদের দেশের গ্রীষ্ম কালের মতোই। শহরের বাইরে ইউরোপীয় সুখ স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এসব সত্ত্বেও যদি তুমি কর্মে প্রবৃত্ত হতে সাহস করো---স্বাগত তুমি, শতবার স্বাগত।"
এই 'স্বাগত' শব্দটি মার্গারেটকে উদ্দীপিত করেছিলো। তাই হয়তো স্বামীজীর প্রয়াণের পরও এদেশে থেকে গেলেন তিনি। স্বামীজীর মাধ্যমেই নিবেদিতা চিনতে পেরেছিলেন ভারতের অন্তরলোক। তাই তিনিও শুরু করলেন গুরুর দেখানো পথে শিব জ্ঞানে জীব সেবা। ১৮৯৯ সালে কলকাতায় প্লেগ মহামারীর রূপ নিলে স্বামীজীর অনুগামীরা এগিয়ে আসেন মানবসেবার মনোভাব নিয়ে, এগিয়ে আসেন রামকৃষ্ণ দেবের গৃহী ভক্তরা, বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী এবং নিবেদিতা। শুরু হলো নিবেদিতার ভারত সেবা। কলকাতা শহর তার জীবনের অপূর্ব দৃশ্য দেখলো। ঝেঁটা, বালতি হাতে এক বিচিত্র ঝাড়ুদারের দল ,যেখানে সবাই ভদ্র সন্তান এবং সামনে আছে নিবেদিতা।এই সেবা কর্মে তাঁর মৃত্যুভয় ছিলো কারণ প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে স্পর্শের মাধ্যমে। তিনি শুধুমাত্র জানতেন কাজ কাজ আর কাজ। আমরণ কাজ করে যাওয়ার মন্ত্র, সেবা করে যাওয়ার মহাজ্ঞান তিনি গুরুর কাছেই পেয়েছিলেন। প্লেগ রোগীর ধারে কাছেও যখন কেউ যাওয়ার সাহস পেতো না ,তখন স্বামীজী এবং তাঁর গুরুভ্রাতারা যেমন সেবা করেছিলেন তাদের মাঝে থেকে ঠিক তেমনই তাদের সাথে ছিলেন নিবেদিতা। সেকালের নামজাদা ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর মহাশয়ের স্মৃতি কথা থেকে জানা যায়,
'একদিন চৈত্রের মধ্যাহ্নে রোগী পরিদর্শনান্তে গৃহে ফিরিয়া দেখিলাম, দ্বারপথে ধূলিধূসর কাষ্ঠাসনে একজন ইউরোপীয় মহিলা উপবিষ্টা। উনিই ভগিনী নিবেদিতা।'
স্বামীজীর বাণীকে নিজের ভেতর ধারণ করতে যে বজ্র কঠিন সাহস লাগে এবং কিছু সহজাত গুণের প্রয়োজন হয় তা নিবেদিতার মধ্যে একশো শতাংশই ছিলো। শুধুমাত্র প্লেগের সেবা কর্মেই নয় স্কুলের জন্য দুপুরের খর রোদে ছাতা মাথায় ছাত্রী খুঁজতে বেরোনো, বিকেলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশ চন্দ্র বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে এবং সন্ধ্যায় বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে,স্বাধীনতার মানে খুঁজে বার করা। কারণ, তরুণ ভারত বলতে তিনি জানতেন স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ,জগদীশ চন্দ্র বসু। তারপর রাত জেগে বই লেখা ,এবং আবার ভোরবেলা উঠে রাস্তা ঝাঁট দিয়ে তাড়ান প্লেগের ব্যাধি। গুরুর ধ্যান জ্ঞানই ছিলো ভারতের প্রকৃত মুক্তি সাধন,আর গুরুর ধ্যান জ্ঞানই ছিলো তাঁর ধ্যান জ্ঞান। শক্তি পক্ষেই তাঁর আসা আর শক্তি পক্ষেই তাঁর চলে যাওয়া অক্লান্ত কর্মযোগে। গুরুর মহান বাণী,
"উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত..." অর্থাৎ Arise, awake and stop not till the goal is reached."
এই বীজমন্ত্র নিজের ভেতর বপন করেই গুরুর দেখানো পথে নেমেছিলেন নিবেদিতা। তাই আজও পাহাড়ের কোলে হয়তো আদরে হয়তো অনাদরে শুয়ে আছেন ভারতকন্যা নিবেদিতা। যিনি গুরুর শেখানো দেখানো পথকেই নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্মে বজ্রাগ্নির মতো প্রতিভাত করেছিলেন।
সুমি ভট্টাচার্য্য
তথ্য সূত্র : বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
গুরু শিষ্যার সম্পর্কই হচ্ছে এক অসামান্য সম্পর্ক। আর গুরু শিষ্যা শব্দটি উচ্চারণ করলেই মনে আসে স্বামীজীর অলৌকিক আবিষ্কার ভারতের জন্য : নিত্য সত্যের নিবেদিতা।
আইরিশ তেজস্বিনী নারীকে কি মন্ত্রে যে স্বামীজী সম্পূর্ণ ভারতীয়াতে আদ্যন্ত রূপান্তরিত করেছিলেন ,তা একমাত্র তিনিই জানেন। স্বামীজীর সংস্পর্শে আসার পর থেকেই মিস মার্গারেট নোবেল তাঁর সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে।একটু অতীতের পথে হাঁটলেই দেখতে পাই উত্তর আয়ারল্যান্ডের ধর্মযাজকের কন্যা লন্ডনের চার্চ বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করে হ্যালিফ্যাক্স কলেজে শিক্ষা জীবন শেষ করেন। আর তারপর থেকেই তাঁর শিক্ষিকা রূপে জীবন শুরু। দু বছরের জন্য তিনি কেসউইকের একটি প্রাইভেট স্কুলে পড়ান। এরপর একে একে রেক্সহ্যামে, চেস্টারে,উইম্বলডনে শিক্ষকতা করেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই উইম্বলডনে নিজের 'রাস্কিন স্কুল' উদ্বোধন করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক , অর্থাৎ সমাজের অন্ধকার, অবক্ষয়ের দিক। ব্রিটিশ শাসকের অত্যাচারে শোষিত ভারতের সাধারণ মানুষ। ঠিক সেই সময় লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডে লেডি ইসাবেলের বাড়িতে সদ্য শিকাগো ধর্মমহাসভা থেকে ফিরে আসা স্বামী বিবেকানন্দের একটি ঘরোয়া সভা বসেছিলো। সেখানেই প্রথম সাক্ষাৎ গুরু শিষ্যার। সেই আলোচনা সভায় স্বামীজীর শিক্ষা প্রসঙ্গে তিনি শুনলেন ,"শিক্ষা হচ্ছে মানুষের সেই পূর্ণতার প্রকাশ, যা তাঁর মধ্যে বিদ্যমান।" সেদিন থেকে মিস মার্গারেটকে স্বামীজীর বাণী, কথা যুক্তি,তর্ক ,বিচার, বিশ্লেষণ মুগ্ধতায় ভরিয়েছিলো।
এরপর থেকেই নিবেদিতার বাকি জীবন যেনো অগ্নিশিখা। ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়ি থেকে শুরু সংগ্রামের এক ইতিহাস। তাঁর গুরুর শেখানো পথে--"মানবসেবার পূণ্যব্রতে"। যে দেশ বারে বারে দূত পাঠিয়েছে , যে দেশ মনে করেছে ভারত মানেই অন্ধকার ,কুসংস্কারে ঠাসা তাই তাকে নিজ ধর্মে, সভ্যতায় স্নান করানোর মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলো ; সেই তাঁদেরই মাতৃভূমি থেকে উঠে এসে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেন নিবেদিতা। ধর্মযাজকের মতো পা অবধি ঢাকা শ্বেত শুভ্র গাউন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কোমরে দড়ির মতো পাকানো রিবন ,মাথায় লম্বা চুল---তবে এলায়িত নয়, খোঁপার আকারে বাঁধা। সমস্ত দেহ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সূর্যের তেজ। মুখ সদা সর্বদা প্রসন্নতায় পূর্ণ। পুরুষের বাহির মহল থেকে মহিলার অন্দর মহল পর্যন্ত যিনি আলোচনার কেন্দ্রস্থল,সেই তিনি নিজের তেজ দিয়ে আগলে রাখলেন ভারতের ঐতিহ্য, ধর্ম,কর্ম,সংস্কারকে। ভারত ছিলো তাঁর কাছে আত্মার আত্মীয়, মন্ত্রস্বরূপ। জপমালা হাতে নিয়ে নিবেদিতা জপ করতেন পাঁচ অক্ষরের সেই অমর মন্ত্র। সেই মন্ত্র কোনো দেবদেবীর মন্ত্র নয়। মন্ত্র ছিলো--"ভারতবর্ষ , ভারতবর্ষ ,ভারতবর্ষ"। তাঁকে যাঁরা খুব কাছ থেকে দেখেছে,অর্থাৎ তাঁর ছাত্রীদের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে,পাঁচ অক্ষরের "ভারতবর্ষ" নাম জপের সময় তাঁর মধ্যে এক অদ্ভুত অপূর্ব ভাবান্তর লক্ষিত হতো। রোমাঞ্চিত হতেন তিনি। তাঁর ছাত্রীদের স্মৃতিকথায় আরও জানা যায় যে, তিনি যখন সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন মনে হতো না রক্ত মাংসের অবয়ব, মনে হতো যেনো অগ্নিশিখা। এই ১৬ নম্বর বোস পাড়া লেনের বাড়িতে এককালে যে বাংলার কতো মনীষী এসেছেন, হয় সাধিকার মানবসেবার আকর্ষণে, হয় আমন্ত্রণে অথবা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে। আর এসে শিউরে উঠেছেন এমন আলো বাতাসহীন বাড়ির পরিবেশ দেখে ! খুব সহজ হয়নি হয়তো তাঁর পক্ষেও সুদূর পাশ্চ্যাতের বিলাসিতাকে ছেড়ে এই হতশ্রী বাড়িকে , এই দুঃখ কষ্ট কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ভারতকে আপন বলে ভাবা কিন্তু তাও তিনি করেছিলেন । ১৬ নম্বর বাড়ির প্রতি তাঁর মমতার কথা তিনি একটি পত্রে লিখেছিলেন,
" আমার বাড়িতে একটি আঙিনা আছে। বাড়ির মধ্যে এই জায়গাটি আমার আকাশ ও তারার সঙ্গে মিলনের স্থান। দিনের বেলা এখানে শীতল ছায়া বিছিয়ে থাকে ও রাতে এটি হয়ে ওঠে অসীমের পূজামন্দির..."
প্রথমে ঠিক হয়েছিলো বোসপাড়া লেনের যে বাড়িতে মা থাকেন সেই বাড়িতেই হবে নিবেদিতার আশ্রয়। কিন্তু ,এই প্রচেষ্টায় বাধা দিলো তখনকার কলকাতার গোঁড়ামি। ব্রাহ্মণী সারদা মায়ের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকবে এই ম্লেচ্ছ জাতের মেয়ে! এ তো জাতধর্মের ওপরে আঘাতই নয় সরাসরি সমাজের বিরোধিতা। অথচ এই তথাকথিত সমাজরক্ষকরা জানতেনও না এই বিদেশিনী ম্লেচ্ছ জাতের মেয়েকে সারদা মা নিজের মেয়ের মতন দেখেন। ডাকেন তাঁকে,"আদরের খুকি" বলে। শত ইচ্ছা থাকলেও নিবেদিতা বুঝতে পেরেছিলেন বাধার পরিমাণ বিপুল এবং গুরুর সেবাকার্য এবং নারীশিক্ষা বিষয়ক স্বপ্নকে সাকার করে তুলতে তাঁকে অন্য বাড়ির সন্ধান করতেই হবে। সমগ্র হৃদয় দিয়ে তিনি অনুভব করেছিলেন অজ্ঞ, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন নারীজাতিকে একমাত্র শিক্ষা দানের মাধ্যমে জাগিয়ে তুলেই হবে তাঁর কর্মপ্রবাহের সূচনা। পেলেন মায়ের বাড়ির উল্টোদিকেই ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়ি। বাঙালি সমাজ যখন আস্তে আস্তে গ্রহণ করতে শুরু করলো তাঁকে, তখন তাঁর বাড়িতে কেউ আসলেই তিনি তাঁকে চেয়ারে বসতে দিয়ে নিজে মাটিতে বসতেন।তিনি সম্পূর্ণ রূপে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন মানুষ নির্মাণের কাজে। গুরুর আশীর্বাদ, অনুপ্রেরণায় নিবেদিতা কঠিন পথকে সুগম করলেন।স্বামীজী একবার গুরুভাইদের বলেছিলেন,
"এরপর দেখবি নিবেদিতার কার্যকরী শক্তি। নিবেদিতার প্রাণ অতি মহৎ। তার ভিতর কোথাও প্রতিষ্ঠা, যশ বা মুরুব্বীয়ানা নেই। তার হৃদয় অতি উদার ,পবিত্র। নিবেদিতা প্রাণ দিতে এসেছে। গুরুগিরি করতে আসিনি।"
অবশেষে এলো সেই পুণ্য লগ্ন। ১৬ নম্বর বাড়িতে এলেন স্বয়ং শ্রী মা, তাঁর গুরুদেব স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী সারদানন্দ। প্রথাগত পূজাপাঠ শেষ করে সারদা মা মৃদু ভাষায় উচ্চারণ করলেন আশীর্বানী,
"আমি প্রার্থনা করি এই বিদ্যালয়ের ওপর জগণ্মাতার আশীর্বাদ বর্ষিত হোক। এখান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েরা আদর্শ কন্যা হয়ে উঠুক।"
নিবেদিতা তাঁর স্কুলের নাম দিলেন 'রামকৃষ্ণ স্কুল ফর গার্লস' ; যা লোকমুখে প্রচারিত হলো সিস্টারের স্কুল। সংস্কারে আচ্ছন্ন কলকাতার মানুষ জেনে গেলো এই বিদেশিনী স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা--ভগিনী নিবেদিতা। হিন্দু ধর্মের 'Tolerance' ও 'Acceptance' এর চিরসত্যকে তিনি বিদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠা দিয়ে এসেছেন, সেই বিদেশ থেকেই তিনি এনেছেন এই 'সিংহীনি' কে,এই দেশের সেবাব্রত সম্পাদনের জন্য। উইম্বলডনের এই শিক্ষিকা মার্গারেটকে তিনি একবার চিঠিতে লিখেছিলেন,
"এ দেশে যে কি কুসংস্কার, কি দুঃখ,কি দাসত্ব ---তা তুমি কল্পনাতেও আনতে পারবে না।জাতি ও স্পর্শ সম্বন্ধে উদ্ভট ধারণা। শ্বেতাঙ্গরা মনে করবে তোমার মাথা খারাপ। ওরা তোমার গতিবিধি সন্দেহের চোখে দেখবে। তা ছাড়া দারুন গরম। আমাদের দেশের শীতকাল তোমাদের দেশের গ্রীষ্ম কালের মতোই। শহরের বাইরে ইউরোপীয় সুখ স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এসব সত্ত্বেও যদি তুমি কর্মে প্রবৃত্ত হতে সাহস করো---স্বাগত তুমি, শতবার স্বাগত।"
এই 'স্বাগত' শব্দটি মার্গারেটকে উদ্দীপিত করেছিলো। তাই হয়তো স্বামীজীর প্রয়াণের পরও এদেশে থেকে গেলেন তিনি। স্বামীজীর মাধ্যমেই নিবেদিতা চিনতে পেরেছিলেন ভারতের অন্তরলোক। তাই তিনিও শুরু করলেন গুরুর দেখানো পথে শিব জ্ঞানে জীব সেবা। ১৮৯৯ সালে কলকাতায় প্লেগ মহামারীর রূপ নিলে স্বামীজীর অনুগামীরা এগিয়ে আসেন মানবসেবার মনোভাব নিয়ে, এগিয়ে আসেন রামকৃষ্ণ দেবের গৃহী ভক্তরা, বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী এবং নিবেদিতা। শুরু হলো নিবেদিতার ভারত সেবা। কলকাতা শহর তার জীবনের অপূর্ব দৃশ্য দেখলো। ঝেঁটা, বালতি হাতে এক বিচিত্র ঝাড়ুদারের দল ,যেখানে সবাই ভদ্র সন্তান এবং সামনে আছে নিবেদিতা।এই সেবা কর্মে তাঁর মৃত্যুভয় ছিলো কারণ প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে স্পর্শের মাধ্যমে। তিনি শুধুমাত্র জানতেন কাজ কাজ আর কাজ। আমরণ কাজ করে যাওয়ার মন্ত্র, সেবা করে যাওয়ার মহাজ্ঞান তিনি গুরুর কাছেই পেয়েছিলেন। প্লেগ রোগীর ধারে কাছেও যখন কেউ যাওয়ার সাহস পেতো না ,তখন স্বামীজী এবং তাঁর গুরুভ্রাতারা যেমন সেবা করেছিলেন তাদের মাঝে থেকে ঠিক তেমনই তাদের সাথে ছিলেন নিবেদিতা। সেকালের নামজাদা ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর মহাশয়ের স্মৃতি কথা থেকে জানা যায়,
'একদিন চৈত্রের মধ্যাহ্নে রোগী পরিদর্শনান্তে গৃহে ফিরিয়া দেখিলাম, দ্বারপথে ধূলিধূসর কাষ্ঠাসনে একজন ইউরোপীয় মহিলা উপবিষ্টা। উনিই ভগিনী নিবেদিতা।'
স্বামীজীর বাণীকে নিজের ভেতর ধারণ করতে যে বজ্র কঠিন সাহস লাগে এবং কিছু সহজাত গুণের প্রয়োজন হয় তা নিবেদিতার মধ্যে একশো শতাংশই ছিলো। শুধুমাত্র প্লেগের সেবা কর্মেই নয় স্কুলের জন্য দুপুরের খর রোদে ছাতা মাথায় ছাত্রী খুঁজতে বেরোনো, বিকেলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশ চন্দ্র বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে এবং সন্ধ্যায় বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে,স্বাধীনতার মানে খুঁজে বার করা। কারণ, তরুণ ভারত বলতে তিনি জানতেন স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ,জগদীশ চন্দ্র বসু। তারপর রাত জেগে বই লেখা ,এবং আবার ভোরবেলা উঠে রাস্তা ঝাঁট দিয়ে তাড়ান প্লেগের ব্যাধি। গুরুর ধ্যান জ্ঞানই ছিলো ভারতের প্রকৃত মুক্তি সাধন,আর গুরুর ধ্যান জ্ঞানই ছিলো তাঁর ধ্যান জ্ঞান। শক্তি পক্ষেই তাঁর আসা আর শক্তি পক্ষেই তাঁর চলে যাওয়া অক্লান্ত কর্মযোগে। গুরুর মহান বাণী,
"উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত..." অর্থাৎ Arise, awake and stop not till the goal is reached."
এই বীজমন্ত্র নিজের ভেতর বপন করেই গুরুর দেখানো পথে নেমেছিলেন নিবেদিতা। তাই আজও পাহাড়ের কোলে হয়তো আদরে হয়তো অনাদরে শুয়ে আছেন ভারতকন্যা নিবেদিতা। যিনি গুরুর শেখানো দেখানো পথকেই নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্মে বজ্রাগ্নির মতো প্রতিভাত করেছিলেন।
সুমি ভট্টাচার্য্য
তথ্য সূত্র : বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
0 Comments
Posting any kind of spam in comment section is prohibited
Emoji