তিন ইয়ারি কথা...

তিন ইয়ারি কথা...

আবার এক তিন ইয়ারি কথা।  তবে এই গল্পের সঙ্গে একেবারেই মিল নেই বাংলা সিনেমা 'তিন ইয়ারি কথা' র। আসলে এ তিন বন্ধুর গল্প নয়, স্মৃতিমেদুরতা। 
                      শীতের সকাল। আকাশে ছড়িয়ে আছে হালকা কুয়াশা আর কুয়াশার চাদরে মুড়ে হিমেল বাতাস যেন আবেশে জড়িয়ে ফেলছে। কিন্তু চোখ বার বার ছুটছে দূরে আসা রেলগাড়ির দিকে আর কান ছোটোবেলার একাগ্রতা নিয়ে ঘোষণা শুনছে। চন্দননগর স্টেশনে অবশেষে বহুপ্রতিক্ষিত সময়ের পর ট্রেন এসে থামলো। মন  বলছিলো,'ঠিক চিনতে পারবো না কারণ এখন তো সে পূর্ণতায় পূর্ণ। সেও কি একই আছে ? সেই আগের মতো কি আসবে আমার কাছে ? সেও তো আমাকে চিনবে না !' ব্যস্ত স্টেশন ,ট্রেনের যাওয়া আসা সব মিলিয়ে মানুষের ভিড়ে সরগরম। কিন্তু কি অদ্ভুত ! অত ভিড়ের মাঝে ওই একটা মানুষ উল্টোদিকে ফিরে কাউকে খুঁজছে একরাশ উদ্বেগ,আবেগ নিয়ে। 
              প্রায় ২৩ বছর পর দেখা সিঁথির সাথে। কাঁধে হাতটা রাখতেই ভাবিনি চেনা ভালোবাসা পাবো। আমার সিঁথি। আমার  ছোটবেলা। দুটো ঝুঁটি , নতুন গুড়ের পায়েসের মতো ছিলো সে মিষ্টি। ঝগড়া, মারামারি তার অভিধানেই ছিলো না। হাসি তার মুখে লেগেই থাকতো।  বন্ধুদের মনোমালিন্য হলেই সিঁথির ছোঁয়ায় তারা আবার প্রাণের বন্ধুর স্পর্শ পেতো। চিনলাম ঠিকই আমরা একে অপরকে কিন্তু আমার মন বারবার বলছে 'লাল ফিতে সাদা মোজার স্কুল ইউনিফর্ম' র কিশোরী কতো বড়ো হয়ে গেছে। আমার মনের কথা ছোটবেলার মতো ঠিক টের পেয়ে গেলো আর জড়িয়ে ধরে আশ্বস্ত করলো 'আমি যে তোর সেই সিঁথি'। শুধুমাত্র বড়ো হয়ে গেছি। আমি ওকে বললাম, 'তোর মনে আছে,তোকে ছোটোবেলায় কি বলে ডাকতাম ?' সিঁথি বললো,
                 'বন্ধু আমার! থেকে থেকে কোন সুদূরের বিজনপুরে
ডাক দিয়ে যাও ব্যথার সুরে ?
আমার অনেক দুঃখ পথের বাসা বারে বারে ঝড়ে উড়ে ,
ঘর ছাড়া তাই বেড়াই ঘুরে...'
               আমার অবাক চোখের ভেজা দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে শুধুই বললো,'তোর সিঁথি আজও তোর কাজী নজরুল ইসলাম আছে।' সময়ের কাঁটা নিজের মতো চলছিলো কিন্তু সেদিকে খেয়ালই ছিলো না। খেয়াল হলো রেলগাড়ি আসার ঘোষণা শুনে। খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের গুছিয়ে নিলাম কৃত্রিম জগতের জন্য, কিন্তু মন বলছিলো আবারও পাবো অকৃত্রিম ভালোবাসার স্পর্শ।
                    ট্রেন এসে থামলো পরবর্তী স্টেশনে। দাঁড়িয়ে আছে উচ্ছাস। প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর, এক মুখ হাসি নিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
'আহা কি সুন্দর, জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না....'
      উচ্ছাস আজও একই ,হাসিখুশি তবে হ্যাঁ সেই 'লাল ফিতে সাদা মোজার স্কুল ইউনিফর্ম' র তালপাতার সেপাই এখন জলভরার মতো সুন্দরী হয়েছে। আজও ডানপিটে ছোটবেলার মতো। মাঠের মাঝে সাইকেল চালাতে চালাতে হঠাৎ করেই জনবহুল রাস্তায় উঠে পড়া। রিকশা কাকুকে রিকশায় বসিয়ে নিজেই চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। দুষ্টুমি আর ঝগড়া ছিলো তার প্রধান অস্ত্র। সিঁথির বিপরীত মেরু ছিলো উচ্ছাস। অথচ কি প্রচণ্ড ভালোবাসা ছিলো তার, আমার আর সিঁথির জন্য। আমাদের কেউ কিছু বললে সবার আগে সেই ছুটত ঝগড়া করার জন্য। অন্যায় হতে যেমন দিতো না আবার আঘাত করেও কাউকে কথা বলতো না। পড়াশোনায় ছিলো বরাবর ভালো উচ্ছাস আর সিঁথি দুজনেই। 
               যে সময়ে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় সেই সময়টা ছিলো চিঠি লেখার যুগ। হাতে হাতে মোবাইল ফোন তো দূরের কথা সব বাড়িতে হয়তো টেলিফোনও ছিলো না। মাধ্যমিক অর্থাৎ স্কুল জীবন ছাড়ার পরই তিন বন্ধু তিন প্রান্তে হারিয়ে গেলাম। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার দৌড়ে। কিন্তু কেউই পারিনি অর্থনৈতিক দিক থেকে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে, কারণ বিবাহিত জীবনের ডাক এসে গেছিলো তিনজনেরই সময়ের আগে। আজ যখন আমরা মায়ের পদে উন্নীত হয়ে গেছি তখন নিজেদের পরিবার থেকে একটু সময় বাঁচিয়ে ছুটলাম আবার নিজেদের বাঁচতে। আসলে বন্ধুত্ব শব্দটি যে মনের নীল আকাশে ডানা মেলে উড়তে থাকা রঙিন ঘুড়ির মতো। শত ব্যস্ততার যান্ত্রিক জীবনের মাঝেও যা এক পশলা সুখের বৃষ্টির ছোঁয়া আনে।  দল বেঁধে স্কুলে যাওয়া, টিফিন ভাগাভাগি করে খাওয়া, নারকোল আইসক্রিম কিনে সবার আগে বড়ো কামড় কে বসাবে, ঘুঘনির শালপাতা শেষকালে কে চাটবে, মাঠে গোল্লাছুট, লুকোচুরি, কানামাছি খেলে বেড়ানো! কথায় কথায় আঙুলে আঙুল ঠেকিয়ে জীবনের ভাব, জীবনের আড়ি আর মাথায় মাথা ঠুকলে শিং বেরোবে সেই সব অমলিন মেয়েবেলার বন্ধুত্ব। সবচেয়ে নিখাদ এক সম্পর্ক যেখানে নেই কোনো ধরা বাঁধা নিয়মের হিসেব। আছে শুধু ভালো লাগার আত্মিক টান।কিশোরী বেলার সেই বন্ধুত্বগুলি যেন মনে হয় সবচেয়ে আপন ,সবচেয়ে কাছের। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা আজও একই রয়ে গেলাম তাই এই অটুট বন্ধুত্বকে  'নিজস্বী' তুলে স্মৃতির মণিকোঠায় রেখে দিলাম। 
             উচ্ছাস আর সিঁথির সাথে আমার অভিজ্ঞতা ও আগ্রহের মিল নেই কিন্তু কোথাও যেন এক আত্মিক টান আছে। গভীর সখ্য। তাই মন বলে উঠলো একসাথে 'প্রাণের মাঝে আয়'। আবেগ (সিঁথির ডাকনাম), উচ্ছাস ও আমার পূর্ণমিলনীতে একটাই কথা অনুভবের অনুভূতিতে হচ্ছিল যে ,একদিন আমরাই পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় বন্দি করতে চেয়েছিলাম কিন্তু  কখন যে নিজেরাই নিজেদের মুঠোতে বন্দি হয়ে গেছি বুঝতেই পারেনি। যখন বুঝতে পারলাম তখন বয়েস আমাদের মধ্যগগনে পা বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে যখন ফিরলাম তখন মন বললো,
 'আমি তো ছিলাম বেশ নিজের  ছন্দে,
  সকালের রোদে আর মাটির গন্ধে...'
           কিশোরী বেলা আর তো ফিরবে না এই বেলাশেষে। আসলে প্রেম আসে আমাদের জীবনে একাধিকবার কিন্তু ভালোবাসা আসে একবারই ঠিক যেমন বন্ধু তুই ,
              'বন্ধু মানে খোলা আকাশ,
           বন্ধু মানে মুক্তি------
              বন্ধু মানে সারাজীবন,
           পাশে থাকার চুক্তি !'

মিশুর লেখায় আবেগ ও উচ্ছাস 
সুমি ভট্টাচার্য্য
 
    

              

Post a Comment

0 Comments