মাহেশ...
"রাধারাণী নামে এক বালিকা মাহেশে রথ দেখতে গিয়েছিল।বালিকার বয়স একাদশ পরিপূর্ণ হয় নাই। তাহাদিগের অবস্থা পূর্বে ভালো ছিলো..........
পুরুষ বলিল,'তোমার বাড়ি কোথায় ?' রাধারাণী বলিল,'শ্রীরামপুর।'
সে ব্যক্তি বলিল,'আমার সঙ্গে আইস---আমিও শ্রীরামপুর যাইব।চলো, কোন পাড়ায় তোমার বাড়ি..."
ঘুম থেকে উঠেই জানলার গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে কন্যা আমার জোরে জোরে পাঠ করে চলেছে তার ইস্কুলের পাঠ্য পুস্তক থেকে সাহিত্য সম্রাটের 'রাধারাণী'। চোখের সামনে আমাকে দেখতে পেয়েই বলে উঠলো, "জানো মা, আজ উল্টো রথ। আজ আমিও জিলিপি,পাঁপড়ভাজা খাবো আর বনফুলের মালা গাঁথবো।" একবিংশ শতাব্দীর মেয়ের থেকে এমন কথাবার্তা শুনে খানিক হাসিই পেলো। কিন্তু ভালো লাগলো, এই ভেবে যে আজও তবে 'রাধারাণী' বেঁচে আছে। কম্পিউটার, স্মার্টফোন, বার্গার, পিৎজা ইত্যাদি তবে রথের ঐতিহ্যের রূপ,রস,গন্ধ, ইতিহাস , আভিজাত্য , সাবেকিয়ানাকে হার মানাতে পারেনি। আমার হাসি তার চোখ এড়িয়ে গেলো না, তাই জিজ্ঞেস করেই ফেললো, 'মা, আজ উল্টো রথ হলেও আমি কিন্তু সোজা থেকেই গল্প শুনবো,মানে সোজা রথ ,তারপরেই না হয় রথ উল্টো হবে। রথ তো পুরীতে হয় বলে জানি। জগন্নাথের রথ নান্দিঘোষ , বলরামের রথ তালধ্বজ ও সুভদ্রার রথ পদ্মধ্বজ তো একসাথেই চলে পুরীতে। শ্রীরামপুরে তবে কি সত্যিই রথ আর রথের মেলা হয় ? নাকি শুধুই গল্প ?' আমি হেসে বললাম, ' তবে আয়, তোকে আজ রথের গল্প বলি। রথযাত্রা বলতে পুরীর কথাই আমাদের সর্বপ্রথমে মনে আসে ঠিকই। কিন্তু, ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা বলতে শ্রীরামপুরের মাহেশের কথাই মনে আসে। ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। আষাঢ় মাসের শুক্লা পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে প্রতিবছর শুরু হয় এই রথযাত্রা। রথযাত্রার সময় মাহেশের স্নানপিঁড়ি ময়দানে প্রায় একমাস ধরে চলে এই মেলা। ৬২৪ বছরের পুরনো এই মাহেশের রথযাত্রা। তবে এখানের রথ পুরীর মতো কাঠের নয় আবার তিনটি আলাদা আলাদা রথও নয়। এখানে রথ একটিই এবং সেটি লোহার। গোল্লা গোল্লা, বড়ো বড়ো চোখের অসমাপ্ত মূর্তি নিয়ে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা বসেন এখানে। কখনো ঝিরিঝিরি বা আবার কখনো মুষলধারায় বৃষ্টি নিয়ে যাত্রা শুরু করেন মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে।' কন্যা বললো, 'মা, এই মাহেশের রথের জগন্নাথ,বলরাম এবং সুভদ্রা এলেন কোথা থেকে ? এঁদেরও কি সেই পুরীর মন্দিরের বৃদ্ধ কারিগর তৈরি করেছিলেন?' আমি বললাম,'না, এই মাহেশের রথযাত্রা এবং এই তিন মূর্তির পিছনে রয়েছে এক কিংবদন্তি। আসলে ভক্তের জন্যই ভগবান এবং তাঁর স্বার্থকতা ভক্তের ভক্তিতেই। শোনা যায়, চতুর্দশ শতকে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু পুরীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছে হয়েছিলো জগন্নাথ দেবকে তিনি নিজে হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবেন কিন্তু পুরীর মন্দিরের পাণ্ডারা বাধ সাধায় তাঁর ইচ্ছা অসম্পূর্ণ থেকে গেলো। মনের দুঃখে তিনি বসলেন আমরণ অনশনে। তিন দিন পর জগন্নাথ দেব দেখা দিয়ে বললেন ,"ধ্রুবানন্দ, বঙ্গদেশে ফিরে যাও। সেখানে ভাগীরথীর তীরে মাহেশ নামে এক গ্রাম আছে।সেখানে তুমি যাও। আমি সেখানে একটি বিরাট দারুব্রহ্ম পাঠিয়ে দেবো।" কন্যা আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,'মা , দারুব্রহ্ম কি?' আমি বললাম,'দারুব্রহ্ম অর্থাৎ নিমকাঠ। এরপর জগন্নাথ দেব বললেন,' সেই কাঠে বলরাম সুভদ্রা এবং আমার মূর্তি গড়ে পুজো করো। আমি তোমার হাতে ভোগ খাওয়ার জন্য উদগ্রীব।" এই স্বপ্ন দেখে ধ্রুবানন্দ মাহেশে এসে সাধনা শুরু করলেন এবং এক বর্ষার দিনে মাহেশের ঘাটে একটি নিমকাঠ ভেসে এলো। তিনি জল থেকে সেই কাঠ তুলে মূর্তি বানিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। কথিত আছে,পুরীতে জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার দিন মাহেশের মন্দিরের চূড়ায় নাকি এক নীলকণ্ঠ পাখী এসে বসে থাকে। ইতিহাস বলে, সন্ন্যাস গ্রহণের পর একবার নবদ্বীপ থেকে পুরী যাওয়ার পথে মহাপ্রভু চৈতন্য দেব এই মাহেশের মন্দিরে আসেন। পুরীর মন্দির প্রসঙ্গে কথিত ছিলো 'নীলাচল' নামটি। মাহেশের মন্দির দেখে মুগ্ধ মহাপ্রভু এই মন্দিরের নাম দেন 'নব নীলাচল'। শ্রীরামকৃষ্ণ দেব,সারদা মা, নাট্যকার গিরিশ চন্দ্র ঘোষ প্রমুখ অনেক বিখ্যাত মানুষের পদধূলি ধন্য এই মাহেশের রথযাত্রা ।
আর আজ এই যে তুই পড়ছিস সাহিত্য সম্রাটের 'রাধারাণী' তার সাথেও জড়িয়ে আছে এক স্মৃতি। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাইপো শচিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ১৮৭৫ সালে রথের মেলায় প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে একটি মেয়ে হারিয়ে গেছিলো। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও এই মেয়েটিকে অনুসন্ধানের অনেক চেষ্টা করেছিলেন। এই ঘটনার দুমাস পরই তিনি লিখেছিলেন 'রাধারাণী'। অর্থাৎ, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের 'রাধারাণী' উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ছিলো এই শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রা।'
কন্যা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,'মা, রথ কি উল্টো হয় ?এমন নাম কেনো ?' আমি বললাম, ' রথ হলো মানুষের দেহ এবং ঈশ্বর হচ্ছেন তাঁর সারথী। জগন্নাথ ,বলরাম এবং সুভদ্রা তিনজনে রথে চেপে মাসির বাড়ি যান তাই তাকে বলে সোজা রথ। আবার ওখানে থেকে ৯ দিন পর রথ ফিরে আসে জগন্নাথ, বলরাম ,সুভদ্রাকে নিয়ে যথাস্থানে। এই ফেরা অর্থাৎ পুনঃযাত্রাকেই বলে উল্টো রথ। উল্টো রথের এক বিশেষত্ব হলো এই সময় জগতের নাথ যান মাসির বাড়ি, আর সেখানে তাঁকে দেওয়া হয় তাঁর প্রিয় মিষ্টি 'পোড়া পিঠে'। রথ থামিয়ে প্রিয় মিষ্টি 'পোড়া পিঠে' খান জগন্নাথ তাঁর দাদা এবং বোনকে নিয়ে। বিষ্ণু পুরাণ মতে,বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রাম এবং অষ্টম অবতার কৃষ্ণ। কথা রাখতে তাই অষ্টম জন্মে জগন্নাথ মাসির বাড়ি গিয়ে 'পোড়া পিঠে' খান। কৈকেয়ী অষ্টম জন্মে কৃষ্ণের মাসি।
আবার, আমার দিদা বলতো এই দিনেই অনেক বনেদিবাড়ির মা দূর্গার কাঠামো পুজোও হয়। অর্থাৎ এই রথযাত্রা ও উল্টো রথ এই দু দিনের কাঠামো পুজো থেকেই শুরু হয়ে যায় মা দুর্গাকে আবাহন। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্যদের মধ্যে কলকাতা বাগবাজারের বলরাম বসু ছিলেন অন্যতম এবং তাঁর রথও বলরাম মন্দিরের রথ নামেই খ্যাত। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেব ও সারদা মা তাঁর বাড়িতে পদধূলি দিয়েছিলেন বলে তিনি তাঁর বাড়িকে মন্দির বলতেন। ঠাকুর প্রথম এই রথের দড়ি স্পর্শ করেছিলেন এবং রথের সামনে নৃত্য কীর্ত্তন করতে করতে ভক্তদের সাথে হেঁটেছিলেন। রথযাত্রায় রথকে বারান্দা দিয়ে ঘুরিয়ে চিলেকোঠার ছাদে রেখে দেওয়া হয় এবং উল্টো রথের দিন জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার রথকে চিলেকোঠা থেকে নামিয়ে আনা হয়। রথের দিন থেকে উল্টো রথের দিন অবধি এখানে দূর থেকে আসা কৃষ্ণকিঙ্কর বেশধারী সম্প্রদায়রা কীর্ত্তন করেন। বলরাম মন্দিরের রথযাত্রার এই হলো বিশেষত্ব।' কন্যা বললো,'মা, এই কথাগুলো কি সত্যি ?' আমি বললাম,'আমিও যে শোনা পাগল ,দেখা পাগল তো নয়।'
কন্যার গোল্লা গোল্লা চোখের সুভদ্রার মতো দৃষ্টি এক নিমেষেই খুশিতে বদলে গেলো কর্তার আগমনে। এক হাতে জিলিপির ঠোঁঙা আর এক হাতে পাঁপড় ভাজার ঠোঁঙা নিয়ে বাবা তার আদরের ধনকে যখন বললো আমার ঠাকুরের কথায়,
"বসেছে আজ রথের তলায়
স্নানযাত্রার মেলা----
সকাল থেকে বাদল হলো ,
ফুরিয়ে এলো বেলা।
আজকে দিনের মেলামেশা,
যতো খুশি যতই নেশা
সবার চেয়ে আনন্দময়
ওই মেয়েটির হাসি----
এক পয়সায় কিনিছে ও
তালপাতার এক বাঁশি ।"
বাবা আর তার আদুরীর স্মৃতিটা সবুজ আর ভাবনাটা নীল থাক এমনই 'নব নীলাচলে।'
সুমি ভট্টাচার্য্য
তথ্যসূত্র : বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
"রাধারাণী নামে এক বালিকা মাহেশে রথ দেখতে গিয়েছিল।বালিকার বয়স একাদশ পরিপূর্ণ হয় নাই। তাহাদিগের অবস্থা পূর্বে ভালো ছিলো..........
পুরুষ বলিল,'তোমার বাড়ি কোথায় ?' রাধারাণী বলিল,'শ্রীরামপুর।'
সে ব্যক্তি বলিল,'আমার সঙ্গে আইস---আমিও শ্রীরামপুর যাইব।চলো, কোন পাড়ায় তোমার বাড়ি..."
ঘুম থেকে উঠেই জানলার গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে কন্যা আমার জোরে জোরে পাঠ করে চলেছে তার ইস্কুলের পাঠ্য পুস্তক থেকে সাহিত্য সম্রাটের 'রাধারাণী'। চোখের সামনে আমাকে দেখতে পেয়েই বলে উঠলো, "জানো মা, আজ উল্টো রথ। আজ আমিও জিলিপি,পাঁপড়ভাজা খাবো আর বনফুলের মালা গাঁথবো।" একবিংশ শতাব্দীর মেয়ের থেকে এমন কথাবার্তা শুনে খানিক হাসিই পেলো। কিন্তু ভালো লাগলো, এই ভেবে যে আজও তবে 'রাধারাণী' বেঁচে আছে। কম্পিউটার, স্মার্টফোন, বার্গার, পিৎজা ইত্যাদি তবে রথের ঐতিহ্যের রূপ,রস,গন্ধ, ইতিহাস , আভিজাত্য , সাবেকিয়ানাকে হার মানাতে পারেনি। আমার হাসি তার চোখ এড়িয়ে গেলো না, তাই জিজ্ঞেস করেই ফেললো, 'মা, আজ উল্টো রথ হলেও আমি কিন্তু সোজা থেকেই গল্প শুনবো,মানে সোজা রথ ,তারপরেই না হয় রথ উল্টো হবে। রথ তো পুরীতে হয় বলে জানি। জগন্নাথের রথ নান্দিঘোষ , বলরামের রথ তালধ্বজ ও সুভদ্রার রথ পদ্মধ্বজ তো একসাথেই চলে পুরীতে। শ্রীরামপুরে তবে কি সত্যিই রথ আর রথের মেলা হয় ? নাকি শুধুই গল্প ?' আমি হেসে বললাম, ' তবে আয়, তোকে আজ রথের গল্প বলি। রথযাত্রা বলতে পুরীর কথাই আমাদের সর্বপ্রথমে মনে আসে ঠিকই। কিন্তু, ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা বলতে শ্রীরামপুরের মাহেশের কথাই মনে আসে। ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। আষাঢ় মাসের শুক্লা পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে প্রতিবছর শুরু হয় এই রথযাত্রা। রথযাত্রার সময় মাহেশের স্নানপিঁড়ি ময়দানে প্রায় একমাস ধরে চলে এই মেলা। ৬২৪ বছরের পুরনো এই মাহেশের রথযাত্রা। তবে এখানের রথ পুরীর মতো কাঠের নয় আবার তিনটি আলাদা আলাদা রথও নয়। এখানে রথ একটিই এবং সেটি লোহার। গোল্লা গোল্লা, বড়ো বড়ো চোখের অসমাপ্ত মূর্তি নিয়ে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা বসেন এখানে। কখনো ঝিরিঝিরি বা আবার কখনো মুষলধারায় বৃষ্টি নিয়ে যাত্রা শুরু করেন মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে।' কন্যা বললো, 'মা, এই মাহেশের রথের জগন্নাথ,বলরাম এবং সুভদ্রা এলেন কোথা থেকে ? এঁদেরও কি সেই পুরীর মন্দিরের বৃদ্ধ কারিগর তৈরি করেছিলেন?' আমি বললাম,'না, এই মাহেশের রথযাত্রা এবং এই তিন মূর্তির পিছনে রয়েছে এক কিংবদন্তি। আসলে ভক্তের জন্যই ভগবান এবং তাঁর স্বার্থকতা ভক্তের ভক্তিতেই। শোনা যায়, চতুর্দশ শতকে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু পুরীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছে হয়েছিলো জগন্নাথ দেবকে তিনি নিজে হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবেন কিন্তু পুরীর মন্দিরের পাণ্ডারা বাধ সাধায় তাঁর ইচ্ছা অসম্পূর্ণ থেকে গেলো। মনের দুঃখে তিনি বসলেন আমরণ অনশনে। তিন দিন পর জগন্নাথ দেব দেখা দিয়ে বললেন ,"ধ্রুবানন্দ, বঙ্গদেশে ফিরে যাও। সেখানে ভাগীরথীর তীরে মাহেশ নামে এক গ্রাম আছে।সেখানে তুমি যাও। আমি সেখানে একটি বিরাট দারুব্রহ্ম পাঠিয়ে দেবো।" কন্যা আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,'মা , দারুব্রহ্ম কি?' আমি বললাম,'দারুব্রহ্ম অর্থাৎ নিমকাঠ। এরপর জগন্নাথ দেব বললেন,' সেই কাঠে বলরাম সুভদ্রা এবং আমার মূর্তি গড়ে পুজো করো। আমি তোমার হাতে ভোগ খাওয়ার জন্য উদগ্রীব।" এই স্বপ্ন দেখে ধ্রুবানন্দ মাহেশে এসে সাধনা শুরু করলেন এবং এক বর্ষার দিনে মাহেশের ঘাটে একটি নিমকাঠ ভেসে এলো। তিনি জল থেকে সেই কাঠ তুলে মূর্তি বানিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। কথিত আছে,পুরীতে জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার দিন মাহেশের মন্দিরের চূড়ায় নাকি এক নীলকণ্ঠ পাখী এসে বসে থাকে। ইতিহাস বলে, সন্ন্যাস গ্রহণের পর একবার নবদ্বীপ থেকে পুরী যাওয়ার পথে মহাপ্রভু চৈতন্য দেব এই মাহেশের মন্দিরে আসেন। পুরীর মন্দির প্রসঙ্গে কথিত ছিলো 'নীলাচল' নামটি। মাহেশের মন্দির দেখে মুগ্ধ মহাপ্রভু এই মন্দিরের নাম দেন 'নব নীলাচল'। শ্রীরামকৃষ্ণ দেব,সারদা মা, নাট্যকার গিরিশ চন্দ্র ঘোষ প্রমুখ অনেক বিখ্যাত মানুষের পদধূলি ধন্য এই মাহেশের রথযাত্রা ।
আর আজ এই যে তুই পড়ছিস সাহিত্য সম্রাটের 'রাধারাণী' তার সাথেও জড়িয়ে আছে এক স্মৃতি। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাইপো শচিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ১৮৭৫ সালে রথের মেলায় প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে একটি মেয়ে হারিয়ে গেছিলো। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও এই মেয়েটিকে অনুসন্ধানের অনেক চেষ্টা করেছিলেন। এই ঘটনার দুমাস পরই তিনি লিখেছিলেন 'রাধারাণী'। অর্থাৎ, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের 'রাধারাণী' উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ছিলো এই শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রা।'
কন্যা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,'মা, রথ কি উল্টো হয় ?এমন নাম কেনো ?' আমি বললাম, ' রথ হলো মানুষের দেহ এবং ঈশ্বর হচ্ছেন তাঁর সারথী। জগন্নাথ ,বলরাম এবং সুভদ্রা তিনজনে রথে চেপে মাসির বাড়ি যান তাই তাকে বলে সোজা রথ। আবার ওখানে থেকে ৯ দিন পর রথ ফিরে আসে জগন্নাথ, বলরাম ,সুভদ্রাকে নিয়ে যথাস্থানে। এই ফেরা অর্থাৎ পুনঃযাত্রাকেই বলে উল্টো রথ। উল্টো রথের এক বিশেষত্ব হলো এই সময় জগতের নাথ যান মাসির বাড়ি, আর সেখানে তাঁকে দেওয়া হয় তাঁর প্রিয় মিষ্টি 'পোড়া পিঠে'। রথ থামিয়ে প্রিয় মিষ্টি 'পোড়া পিঠে' খান জগন্নাথ তাঁর দাদা এবং বোনকে নিয়ে। বিষ্ণু পুরাণ মতে,বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রাম এবং অষ্টম অবতার কৃষ্ণ। কথা রাখতে তাই অষ্টম জন্মে জগন্নাথ মাসির বাড়ি গিয়ে 'পোড়া পিঠে' খান। কৈকেয়ী অষ্টম জন্মে কৃষ্ণের মাসি।
আবার, আমার দিদা বলতো এই দিনেই অনেক বনেদিবাড়ির মা দূর্গার কাঠামো পুজোও হয়। অর্থাৎ এই রথযাত্রা ও উল্টো রথ এই দু দিনের কাঠামো পুজো থেকেই শুরু হয়ে যায় মা দুর্গাকে আবাহন। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্যদের মধ্যে কলকাতা বাগবাজারের বলরাম বসু ছিলেন অন্যতম এবং তাঁর রথও বলরাম মন্দিরের রথ নামেই খ্যাত। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেব ও সারদা মা তাঁর বাড়িতে পদধূলি দিয়েছিলেন বলে তিনি তাঁর বাড়িকে মন্দির বলতেন। ঠাকুর প্রথম এই রথের দড়ি স্পর্শ করেছিলেন এবং রথের সামনে নৃত্য কীর্ত্তন করতে করতে ভক্তদের সাথে হেঁটেছিলেন। রথযাত্রায় রথকে বারান্দা দিয়ে ঘুরিয়ে চিলেকোঠার ছাদে রেখে দেওয়া হয় এবং উল্টো রথের দিন জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার রথকে চিলেকোঠা থেকে নামিয়ে আনা হয়। রথের দিন থেকে উল্টো রথের দিন অবধি এখানে দূর থেকে আসা কৃষ্ণকিঙ্কর বেশধারী সম্প্রদায়রা কীর্ত্তন করেন। বলরাম মন্দিরের রথযাত্রার এই হলো বিশেষত্ব।' কন্যা বললো,'মা, এই কথাগুলো কি সত্যি ?' আমি বললাম,'আমিও যে শোনা পাগল ,দেখা পাগল তো নয়।'
কন্যার গোল্লা গোল্লা চোখের সুভদ্রার মতো দৃষ্টি এক নিমেষেই খুশিতে বদলে গেলো কর্তার আগমনে। এক হাতে জিলিপির ঠোঁঙা আর এক হাতে পাঁপড় ভাজার ঠোঁঙা নিয়ে বাবা তার আদরের ধনকে যখন বললো আমার ঠাকুরের কথায়,
"বসেছে আজ রথের তলায়
স্নানযাত্রার মেলা----
সকাল থেকে বাদল হলো ,
ফুরিয়ে এলো বেলা।
আজকে দিনের মেলামেশা,
যতো খুশি যতই নেশা
সবার চেয়ে আনন্দময়
ওই মেয়েটির হাসি----
এক পয়সায় কিনিছে ও
তালপাতার এক বাঁশি ।"
বাবা আর তার আদুরীর স্মৃতিটা সবুজ আর ভাবনাটা নীল থাক এমনই 'নব নীলাচলে।'
সুমি ভট্টাচার্য্য
তথ্যসূত্র : বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
0 Comments
Posting any kind of spam in comment section is prohibited
Emoji