জীবনের ভয়ঙ্করতম অভিজ্ঞতা

'আমার জীবনের ভয়ঙ্করতম অভিজ্ঞতা'



যে সময়টার কথা বলছি তখন আমি বিএড র ছাত্রী। কলেজের হোস্টেলে জায়গা না পাওয়ায় সৌভাগ্যবশত কলেজের খুব কাছেই এক বন্ধুর শশুরবাড়িতে অতিথিরূপে বেশ কিছুদিন ছিলাম। বন্ধুটি আমার স্কুল জীবনের বন্ধু ছিলো কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তার বিয়ে হওয়ার সুবাদে সকল সম্পর্কই প্রায় ছিন্ন হয়ে গেছিলো। আবার নতুন করে যোগাযোগ, নতুন করে  স্মৃতিমেদুরতায় ডুবে যাওয়া। যে কয়েকদিন ওদের বাড়িতে ছিলাম অতিথি কম বাড়ির মেয়ের আদরই পেয়েছি আর বন্ধুটি যে আমার পরম সুখে ,শান্তিতে ,স্বচ্ছন্দ্যে আছে তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু বার বার মনে হচ্ছিলো যা দেখছি শুনছি তার সবটা সত্যি নয় , ঘটনার আড়ালে হয়তো অন্য ঘটনা ঘটছে। কিন্তু কি ঘটছে তা বুঝতে পারতাম না !
                       তখন রাত প্রায় দেড়টা। খুব অস্বস্তি বোধ হওয়ায় ঘুম ভেঙে গেলো তাই ঘরের লাগোয়া ছাদে চাঁদের আলোয় বেরিয়ে পড়লাম। বন্ধুর  শশুরবাড়িটিকে  এক কথায় বলা যায় রাজপ্রাসাদ। শুনেছিলাম এই বাড়ির পূর্বপুরুষ ছিলেন কোনো এক সময়ের জমিদার এবং তারই তৈরি এই অট্টালিকা। যাই হোক, চাঁদের আলোয় আর আবছা ছায়ায় বাড়িটি বেশ ভুতুড়ে আকার ধারণ করেছিলো মাঝরাতে। ভুতের ভয় ছোটো থেকেই আমার ছিলো কিন্তু ভুতের সাক্ষাৎ সৌভাগ্যবশত কোনকালে ঘটে নি। আমার ঘরের ঠিক উল্টো দিকের ভবনটি ছিলো আমার বন্ধু দ্রিমির। ওর ঘরের আলো অনেক আগেই নিভে গেছিলো কিন্তু পর্দার আড়ালের মৃদু আলো তার আভাস দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল। দ্রিমির ঘরের সাথেও ছিলো এক লাগোয়া ছাদ। আমার মনে হলো, আমি হয়তো ভুল দেখছি কারণ আলোর হালকা উপস্থিতিতে আর যেই আসুক অন্তত ভুত আসবে না। কিন্তু তাহলে ওটা কে ? দোতলার ঘরের ছাদের আলসে ঘিরে ফুলের টব আর সেই আলসের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে কে যেনো আপন মনে গান গেয়ে চলেছে কিন্তু ঠিক গান নয় যেনো নীরব যন্ত্রণা। আমি ভয় পেয়েও নিজের সাহস বজায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। তারপর সেই ছায়ামূর্তি নিজের মতো উঠে চলে গেলো আর দ্রিমির  ঘরও হঠাৎ আবছা আলো থেকে পূর্ণ অন্ধকারে ডুবে গেলো। সকালে দ্রিমির ডাকে ঘুম যখন ভাঙলো তখন ওকে একান্তে পেয়ে বলেই ফেললাম গতকাল রাতের ঘটনা। দ্রিমি ঘটনাটি আমার চোখের ভুল এবং আমি যে এখনো ভুতের ভয় পাই সেই নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলো। আমিও সেই মুহূর্তে ওর তালে তাল মেলাতে গিয়েও মেলাতে পারছিলাম না কারণ মন বলছিলো কিছু তো কথা আছে যা লুকিয়ে যাচ্ছে দ্রিমি আর ওর মুখের শুকনো ভাব,চোখের দৃষ্টি যেন জানান দিচ্ছে কিছু অদৃশ্যতার। এরপর আর কোনো রাতেই সেই ছায়াময়কে দেখা যায় নি। আমার সময় নির্দিষ্ট  ছিলো কাজের জায়গা থেকে ফেরার কিন্তু সেইদিন বেশকিছু assignments submit করতে গিয়ে বেশ দেরি হয়ে গেছিলো। আমার ঘর একটু বাইরের দিকে হওয়ার ফলে নিজের কাছেও নিজের ভবনে যাওয়ার একটা আলাদা চাবি ছিলো। রাত তখন প্রায় অনেকটাই হয়ে গেছে আর শরীরও ক্লান্ত থাকায় তাড়াতাড়ি নিজের খাওয়া দাওয়া সেরে বিছানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ঘরের আলো নিভিয়ে এক অদ্ভুত টান অনুভব করলাম ছাদের জন্য। ছাদে চলেও গেলাম নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। চোখ আবারও চলে গেলো দ্রিমির ছাদের দিকে। দেখলাম একই পদ্ধতিতে বসে আছে সেই ছায়াময় এবং কি যেন বলে চলেছে নিজের মনে করুন সুরে। নিজেকে আর স্থির রাখতে না পেরে জোরালো টর্চের আলো ফেললাম ছায়াময়ের ওপর। যা দেখলাম তাতে আমার রক্ত শূন্য হয়ে গেলো ! হয়তো ভুত দেখলেও আমি এতো ভয় পেতাম না।
                         এ যে দ্রিমি ! চুল গুলো খোলা, জামা কাপড় বিচ্ছিন্ন , চোখের দৃষ্টি ফেকাসে। টর্চের আলো মুখে পড়ার সাথে সাথেই তাড়াতাড়ি নিজেকে গুছিয়ে নিয়েই দৌড়ে পালালো ওর ঘরের দিকে। আর ওর ঘরও ডুবে গেলো পূর্ণ অন্ধকারে। পরের দিন আমি একান্তে দ্রিমিকে পেয়েই জিজ্ঞেস করলাম সত্যিটা কি এবং আর লুকোনোর কোনো কারণ নিশ্চয়ই আর তো ও দেখাতে পারবে না। দ্রিমি আমার হাত দুটো ধরে মেঝেতে বসে পড়লো আর অঝোরে কাঁদতে লাগলো। আমিও ওকে না থামিয়ে খানিক কাঁদতে দিলাম ,তারপর খানিক প্রকৃতস্থ হতে যা শুনলাম তাতে আমার মনে হলো এমন কথা খবরের কাগজে পড়ি কিন্তু সত্যিই এই ঘটনা ঘটছে তবে। দ্রিমি বললো,'তোর সঙ্গে আমার যখন ছাড়াছাড়ি তখন খুব কমদিনের আয়োজনে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো আমার এই পোড়া রূপের সুবাদে। ভালোবাসতাম মনে মনে যাকে তাকে ভালোবাসা জানানোর সময়ই আর পেলাম না। আর ১৮ বছর হয়ে গেছে যখন,লেখাপড়ায় সাধারণ তাই অসুস্থ বাবা মা আর ভরসা করতে পারলো না যে এই মেয়ে ভবিষ্যতে আমাদের দেখবে। তাই 'ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে' এই প্রবাদ সত্যি করে দিলো। আমরা ছিলাম অতি সাধারণ ঘরের আর এরা যে উচ্চবিত্ত তা তো দেখছিস।' আমি বললাম ,'তাতে কি ? তোর শশুর শাশুড়ী ননদ জা ভাসুর প্রতিটি বাড়ির সদস্য যে তোর এতো যত্ন করে এবং সব থেকে বড়ো কথা তুই যে স্বামী সোহাগিনী তা তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে এই সবের কারণ কি?' দ্রিমি বললো,'তুই যা দেখছিস তার সবটা কেন একটুও সত্যি নয়। বিয়ের পর কিছু দিন বেশ ভালোই ছিলাম। নতুন অতিথির আগমনের একটু বেশিই তাড়া ছিলো সবার কিন্তু মা আমি হতে পারছিলাম না। তারপর ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেলো আমার থাইরয়েড রোগের কথা। আমার বাবা মা আমার রোগ লুকিয়ে বিয়ে দিয়েছে এই নিয়ে শুরু হলো কথা।  এই বংশের প্রদীপ কোনোদিন আসতে পারবে না সেই নিয়ে শুরু হলো স্বামীর দুর্ব্যবহার।  কিন্তু মাস খানেক যেতে না যেতেই ডাক্তারের ওষুধ আর মা ষষ্ঠির কৃপায় আমার মা হওয়ার অনুভূতিটা আস্তে আস্তে মনের সঙ্গে শরীরকেও জানান দিতে শুরু করলো। বাড়িতে আবার  খুশির পরিবেশ একই রকম বইতে শুরু করলো, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আমার প্রবল আপত্তি সত্বেও গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করলো। শেষ করলো এরা আমার প্রথম কন্যা সন্তান গর্ভেই। এর পর আরও দুটো শেষ গর্ভেই। কারণ তারাও ছিলো কন্যা। তোর মনে আছে আমাদের স্কুলে বাংলার দিদিমণি একবার একটা কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছিলো?
    'চারিদিকে ভয় আর ভয়,যদি পুত্র না হয়
        একটাই তো লিঙ্গ আছে মোটে....
না হওয়া তুলতুলে হাত,বুক,পেট,মাথা....
        ভেসে চলে যমুনার স্রোতে আমাদের মহান ভারতে,
    তবু বেঁচে আছি....'
            বুঝিনি তখন যেমন এই কবিতার  মর্মার্থ ,ঠিক তেমনি বুঝিনি যে এই কবিতাই বাস্তব রূপ নেবে আমার জীবনে। এরপর শুরু হলো অকথ্য অত্যাচার বাড়ির প্রতিটি সদস্যের এবং তার সাথে আমার স্বামীরও। প্রতিবাদ করার ভাষা ছিলো না কারণ বাবা মাকে জানাতে তারাও বলেছিলো,'শশুরবাড়ির কথা বাপেরবাড়িতে বলতে নেই। নিজের সমস্যা নিজেই মেটাও।' তাদের গলগ্রহ হয়ে উঠেছিলাম হয়তো তাই মুক্তি পেতে চাইতো তারা। আমি পারলাম না এখনো পুত্র সন্তানের জননী হয়ে গরবিনি হতে।'
 এই অবধি বলেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে চলে যেতে যেতে আপন মনেই দ্রিমি বলে উঠলো,
        'দূর দেশ থেকে হেঁটে আসছিলাম,কোন ইতিহাস থেকে
কবে যেন আমাদের জন্ম হয়েছিল, আমরা অর্থাৎ নারী,রমণী,মানবী
আমাদের জন্মকথা লেখাই হয়নি
ব্রহ্মা থেকে মনু আর মনু থেকে মানব সন্তান
          আশ্চর্য !
এই ইতিহাসে কোনো নারী জন্ম নেই....
ঋকবেদ থেকে একুশ শতক পর্যন্ত আমার বিচরণকাল। ইতিহাসের ছাই এবং ভস্মের মধ্যে যে নারী নামক  আগুন চাপা পড়ে আছে, আমি সেই নারী। আমি আগুনের আত্মকথন।'
                     সেদিনই আমি নিজের কাজের জায়গায় গিয়েই দ্রিমির জন্য কাজ ঠিক করলাম। ওর পছন্দের ছোট্ট ছোট্ট অনাথ  শিশুদের পড়ানোর ব্যবস্থা। মন বড্ড অস্থির হচ্ছিলো, শুধু মনে হচ্ছিলো দ্রিমি এখন কি করছে ! মন কেনো জানিনা খুব কু গাইছিলো বলেই খুব তাড়াতাড়ি নিজের কাজ মিটিয়ে বাড়ি এসে দ্রিমি দ্রিমি করে ডাকতে ডাকতেই বাড়ির ভেতরে চলে এলাম আর সোজা গেলাম ওর ঘরের উদ্দেশ্য। আর তারপরে জানালার কাঁচ দিয়ে নিজের চোখে যা দেখলাম তা বিশ্বাস করা যায় না। দ্রিমি গায়ে কেরোসিন তেল ঢালছে ! আমি পাগলের মতো চিৎকার শুরু করে দিলাম ,জানলার কাঁচ ভাঙার চেষ্টা করতেই থাকলাম তবুও ভাঙতে পারলাম না। আর দরজা ধাক্কা দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেলাম তবুও দ্রিমি থামলো না এবং দরজাও খুললো না দেখে আমি বাড়ির বাকি সদস্যদের ডেকে আনতে গেলাম। কিন্তু হায় ! আমি বাড়ির প্রতিটি সদস্যের কাছে গেলাম কিন্তু কেউ আমার কথার গুরুত্ব অবধি দিলো না।  দ্রিমির শাশুড়ি,শশুর, ননদ এমনকি ওর স্বামী অবধি বললো,'এই নাটক আগেও চলেছে। কিছুই হয়নি। শুধুমাত্র দু'লিটার কেরোসিন তেল নষ্ট হয়েছে। আপনি এতো ভাববেন না। আসলে আপনার বন্ধুটির মাথা খারাপ হয়ে গেছে সন্তান না হওয়ার জন্য।' আমি বাকরোধ হয়ে গেলাম ওদের অমানবিকতা দেখে ! শেষে ব্যর্থতা নিয়ে ঘর থেকে বেরোনোর সময় বাড়ির মালিকে দেখতে পেলাম। প্রথমেই তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার হাতে পায়ে ধরে, তাকে নিয়ে যখন দ্রিমির ঘরের সামনে এলাম তখন সব শেষ ! এসে দেখি , আগুন শুধুমাত্র আগুন আর পোড়া গন্ধে ভেসে যাচ্ছে বাড়ি।  দ্রিমি নিজেকে পুড়িয়ে ফেলেছে !  মালির চিৎকারে সবাই তখন অবশেষে উপস্থিত হলো সেখানে। অর্ধদগ্ধ অচৈতন্য দেহটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করতে শুরু করলো তখন সবাই। আমি মনে প্রাণে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলাম তার সুস্থতার।
                 আর থাকতে ইচ্ছে করলো না এক দণ্ড ওখানে তাই নিজের জিনিস গোছাতে ঘরে এলাম। গুছিয়ে নিয়ে বেরোনোর মুখে বাড়ির মালির ছোট্ট মেয়ের হাতে একখানি চিরকুট পেলাম।খুলে দেখি দ্রিমির লেখা,
       "প্রভু সাজার ইচ্ছা হলে,প্রেমিক তুমি নও
      ভালোবাসবো, আদর দেবো বন্ধু যদি হও।"   চিঠিখানি পড়ে মন বলে উঠলো তুই এই জন্মে আর ফিরিস না এই পৃথিবীতে কিন্তু পরের জন্মে কন্যা সন্তানের মা  যেন আবারও হতে পারিস নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করে।  খবর পেয়েছিলাম দ্রিমি মারা গেছিলো হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পথেই। আমার জীবনের ভয়ংকরতম অভিজ্ঞতা দ্রিমি। এমন অভিজ্ঞতা যেন কোনোদিন কারুর নাহোক। আমাদের বাংলা দিদিমণির কবিতা আজ খুব মনে পড়ে যাচ্ছে,
  "নারী তুমি বেঁচে ওঠো
    নিঃশ্বাস নাও এই অমল হাওয়ায়
এই আকাশ তোমার,আকাশের সব নক্ষত্র তোমার.....
আর যেন কোনো নারীকে কেবল গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য
পেরোতে না হয় এমন দুর্গম অরণ্য,
আর যেন কোনো পুরুষ গুহা থেকে বেরোতে না হয় কোনো রক্তাক্ত নারীকে.....
          তুমি আদ্যন্ত তোমার
           তুমি আমূল তোমার।।"

সুমি ভট্টাচার্য্য।

Post a Comment

0 Comments