অনির_অতীত

 অনির_অতীত

কয়েক দিন হল অনির একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেটা নিয়েই তার বাবা একটু যেনো চিন্তিত। সে ইদানিং ইতিহাস পড়তে ভালোবাসে, এমনকি তার ঐতিহাসিক জিনিসপত্রের প্রতিও একপ্রকার আকর্ষণ বেড়েছে। অবিশ্যি এটা কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, অনি নাকি ইতিহাস বই পড়তে পড়তে গল্পগুলো সব কিছু দেখতে পায় তারই চোখের সামনে। এটা শুরু হয়েছে ওই ক্লাস নাইন এ ওঠার কিছু দিন পর থেকেই। সেবার গরমের ছুটিতে বাবা যখন বললো, বাবু চল, তোকে জাদুঘর টা দেখিয়ে আনি, ছেলে তখন এক পায়ে খাড়া। সেখানে যাবার তার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল। তার ইংরেজি প্রাইভেট মাস্টার একবার পুরো ব্যাচকেই নিয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু সেবার তার যাওয়া হয়নি জ্বর এর কারনে। 

দুদিন পরে জাদুঘরে গিয়ে নানা জিনিস দেখতে দেখতে সে বারবার পিছিয়ে পড়তে থাকে। বেশির ভাগ জিনিসই দেখার সময় সে যেনো আপন মনেই কি সব আওড়াতে থাকে। বাবা প্রথমে ভাবলেন, হয়ত সে ওই সমস্ত তথ্য গুলো পড়ছে প্লেট থেকে, কিন্তু না, সেটা নয়। কারণ তার পরে একটা স্তম্ভ দেখে যখন অনি বললো, " বাবা, এটা তো আফ্রিকা থেকে আনা.!? " তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। কারণ ওই স্তম্ভের তথ্য সংক্রান্ত প্লেটটা অনির বাবার একেবারে সামনে ছিল, যেটা অনির কাছ থেকে অন্তত তিনহাত দূরে এবং সবচেয়ে বিষ্ময়ের ব্যাপার, সত্যিই তাতে আফ্রিকাই লেখা।

বীরেন বাবু, মানে অনির বাবা ঘরে ফিরে সব খুলে বললেন অনির মাকে, শুধু ঐ একটা না, আরো কয়েকটি অবিকল একই ঘটনা। তিনি এও বললেন যে এই ব্যাপার টা নিয়ে একবার শৈলেন দার সাথে কথা বলবেন। কিন্তু শালিনী দেবী কিছুতেই রাজি হলেন না। অবশেষে খানিকটা জোরপূর্বকই রাজি করালেন বীরেন বাবু। বলে রাখি, শৈলেন দা হলেন শালিনী দেবী, মানে অনির মায়ের ঘনিষ্ঠ বাল্য বন্ধু এবং একজন ডাক্তার। শালিনী দেবী, পারিবারিক যেকোনো সমস্যাতেও তাঁর সাথেই পরামর্শ করতেন। বিয়ের পর পর সেই ঘনিষ্ঠতা থাকলেও, অনি হবার পর থেকে সেরকম দেখা সাক্ষাৎ নেই বললেই চলে। এমনকি বীরেন বাবুর ইচ্ছে সত্বেও শালিনী দেবী অনির কোনো বার্থডে পার্টিতেও ডাকেননি শৈলেন বাবুকে। তার কারণ অবশ্য বীরেন বাবুর অজানা।

যাই হোক, কথা মত একদিন বেরোলেন তাঁরা। বাস থেকে নেমে খানিকটা হাঁটা পথ, তাই মেইন রাস্তা ধরেই হাঁটছিলো সবাই, হটাৎ অনি, বাবার হাত টা ছাড়িয়ে ডানদিকে রাস্তা ক্রস করে দৌড় দিল। 

বাবা, অনি বলে জোরে ডাক দিলেন। এবং রাস্তা ক্রস করতে যাবেন, এমন সময় সিগন্যাল টা দিল ছেড়ে..!!

অগত্যা, দাড়িয়ে থাকা..!!

ওদিকে অনি যেখানে ঢুকেছে, সেটা একটা জরাজীর্ণ ভগ্নপ্রায়, জমিদার বাড়ি। ঢুকেই সে হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেটার দিকে, আর বিড় বিড় করতে লাগলো। সে যেনো তার চোখের সামনে দেখতে পেলো কতকগুলো এলোমেলো ঘটনা। দেখলো, চারিদিকে রমরমা, তার সাথে প্রজাদের অনৈচ্ছিক হুংকার। আর মাঝখানে স্বয়ং জমিদার, একটা মূর্তির উপর থেকে ঢাকা দেওয়া কাপড়টা সরাচ্ছেন।অন্যদিকে একটা ঘরে চোখ যেতেই, অনি শিউরে উঠলো, ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে রক্তাক্ত একটা কাটা হাত, পাশেই প্রহরীর হাতে রক্তাক্ত তলোয়ার, সে একটা মোহরের  থলি লোকটির আরেকটা হাতে গুঁজে দিয়ে বলল 

" নে এটা..! আর মনে রাখবি, এটাই তোর গড়া শেষ মূর্তি...!! "

অকারনেই চোখের পাতা পড়ল অনির। চোখ যখন খুললো, সে দেখলো, চারিদিকে আলো, ঢাকের আওয়াজ, প্রজারা লাইন করে দাড়িয়ে খুশিমনে বস্ত্র সংগ্রহ করছে, সয়ং জমিদার তাদের হাতে বস্ত্র তুলে দিচ্ছেন। পাশেই ঠাকুর দালানে মায়ের মূর্তি, আরতি চলছে, আর সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে রয়েছে মায়ের সেই অপরূপ সুন্দর মুখটির দিকে।

আবারও অনির চোখের পাতা পড়লো।

যখন খুললো, শুনতে পেলো তাকে কেও নাম ধরে ডাকছে, পিছন ফিরে দেখল বাবা ও মা পিছনেই..! মা বললেন, কিরে অনি, ওভাবে দৌড়লি কেনো.? রাস্তায় কত গাড়ি হুঁশ আছে..!? অনি মাথা নিচু করেবললো, সরি মা, কিন্তু মা আমরা যাবো কোথায়.!? বাবা বললেন, সামনেই শৈলেন কাকুর বাড়ি, ওখানেই আমরা যাবো।

৫ মিনিট হাঁটার পর তাঁরা উপস্থিত হলেন একটা ছোট্ট কিন্তু পুরনো আমলের বাড়ির সামনে। এ বাড়িতে অনির আসা প্রথমবার। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই কিছুটা এগিয়ে একটা ছোট্ট বৈঠকখানা। এখানে পুরনো জিনিসের একেবারে মেলা বললেই চলে। সেখানে পুরনো বই থেকে শুরু  করে নানারকম মূর্তি ও স্থাপত্য এবং কয়েকটি দেওয়াল ভর্তি পেন্টিং তার সাথে বেশ কিছু তৈলচিত্র। তাঁর যে পুরনো জিনিসের প্রতি বেজায় টান, তা বলাই বাহুল্য। শৈলেন বাবু দেওয়ালের ওই একটি তৈলচিত্রেরই দিকে তাকিয়ে ছিলেন গভীর দৃষ্টিতে,আর কি যেনো বিড়বিড় করছিলেন। তৈলচিত্রটি ছিল একটি জমিদার মহলের। ওনাদের ঢুকতে দেখে তিনি বললেন, এসো এসো।

তা বীরেন, এতদিন পর তাহলে পায়ের ধুলো পড়লো..!? বিরেনবাবু একটা নিরস হাসি হেসে বললেন, তা বৈকি! ওই বৈঠকখানার ঘরেই বসলেন তাঁরা সবাই, আর একপ্রকার পল্প শুরু হলো।হটাৎ বীরেন বাবুর ফোন আসায়, তিনি " এক্সকিউজ মি " উঠে গেলেন। ঠিক তখনই শৈলেন বাবু, মায়ের পাশে বসে থাকা অনির দিকে একটা শান্ত, স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন এবং পূর্বের সেই তৈলচিত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা অনিবাবু....

" কেমন দেখলে জমিদার, মূর্তি আর ওই দুর্গাপুজো..!? "




Post a Comment

0 Comments