সত্যপীর

সত্যপীর


"অখন্ড মণ্ডলা কারং ব‍্যাপ্তং যেন চরাচরম ।
তদপদং  দর্শিতং যেন তস্মৈ  শ্রী গুরুবে নমঃ।।"

আজ গুরু পূর্ণিমা। বেশ পুজো পুজো গন্ধ  বাড়িতে কারণ আজ অনেকদিন পর বাড়িতে সত্যনারায়ন পুজো। আর সত্যনারায়ন পুজো মানেই সিন্নি আর বাতাসা। সিন্নি মাখার দায়িত্ব পেয়ে  বেশ আনন্দই হচ্ছিলো কারণ সিন্নি মাখতে গিয়ে কথা বলা যাবে না,আর আমার কন্যা রত্ন বেশ জব্দ হয়ে গেছিলো তার সব সময়ের কথা বলার সঙ্গীকে কিছুক্ষনের জন্য না পেয়ে। সিন্নি মাখা শেষ হতেই সে  জিজ্ঞেস করলো,"আচ্ছা মা, ঠাকুরের সিংহাসনের ওপর প্রথমে ছুরি রেখে নতুন গামছা পেতে এই যে চার দিকে তুমি  একটা  করে আস্ত পান রেখে তারওপর একটা আস্ত সুপারি , একটা কলা, একটা বাতাসা, একটা এক টাকার কয়েন, এক টুকরো হলুদ ও একটা পৈতে রাখলে আর বলছো যে এই চারটে মোকাম ব্রাহ্মণকে দান করা হবে ,তাহলে মাঝখানের মোকাম কাকে দেবে ? ওটা আমার চাই।" আমি বললাম,"ওই মাঝখানের মোকাম যে মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো মানুষকে দান করতে হয়।" কন্যা আমার  দিকে খুব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,"হিন্দু ধর্মের পুজোতে, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের কি ভূমিকা ? যদিও খুব ভালো লাগছে শুনে যে জাত একটাই আর তা হলো মানুষ। কিন্তু কেন সেটাও জানতে চাই।"

               কন্যা রত্নের সুন্দর প্রশ্ন শুনে মন পিছিয়ে গেলো সুদূর অতীতে, সেই ছোটবেলায়। বাড়িতে এমনই  ছিলো সত্যনারায়ণ পুজোর পরিবেশ আর পুজোর শেষে আমার দিদার হাত দিয়ে দান মাঝখানের মোকাম আমার প্রাণের বন্ধু লায়লাকে, যে ছিলো মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়ে। দিদাকে জিজ্ঞেস করাতে দিদা বলতো নারায়ণ যে ফকির রূপেই এসেছিলো।কন্যার ডাকে চমক যখন ভাঙলো তখন দেখি নিমন্ত্রিতরা উপস্থিত আর যার কথা সব থেকে বেশি মনে পড়ছিলো কন্যার এমন দৃঢ়তা পূর্ণ প্রশ্নে আর উত্তর যুক্তি দিয়ে না দিলে আমার পরিত্রাণ নেই, সেই মুহূর্তে সেই মানুষটির উপস্থিতি তার নির্মল আভিজাত্যপূর্ণ হাসি নিয়ে আমার প্রাণে স্বস্তির নিঃশ্বাস এনে দিলো। বিচক্ষণ , প্রাজ্ঞ , দূরদর্শী, মেধাবী বন্ধু আমার ফাহিম। সাহিত্য এবং ইতিহাস জগতে তার অবাধ বিচরণ। কন্যার প্রশ্ন তার কানেও গেছিলো বলে ইশারায় আমাকে স্বস্তি দিয়ে সেই বসলো কন্যাকে নিয়ে বোঝাতে। আর কন্যা আমার তাকে পেয়েই খুব খুশি।
      ফাহিমকে জিজ্ঞেস করলো কন্যা,"এই হিন্দু পুজোতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভূমিকা কেন ? মাঝখানের মোকাম দিতেই বা হয় কেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে ? " কন্যার একঝাঁক প্রশ্নের উত্তরে ফাহিম বললো নিজের দৃপ্ত ভঙ্গিতে,"তোমার মনের সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আমি চেষ্টা করছি যথাসাধ্য। আজকের এই যে পুজো সত্যনারায়নের, তাঁর আরেক নাম হলো সত্যপীর।  সত্যনারায়ণ ও সত্যপীরের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। সবই এক। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অনুযায়ী  সত্যপীরের জন্ম এই বাংলাতেই।  এই মতাদর্শ আসলে  সত্যনারায়ন ও পীরের মেলবন্ধন।   হিন্দু ও মুসলিম এই দুই  ধর্মীয় মতাদর্শে   অনুপ্রাণিত এক ধর্ম।     সত্যপীর যেমন মুসলিম ঘরে পুজিত হন তেমনই  সত্যনারায়ন পুজোর নিয়মে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এই  মাঝের মোকাম বরাদ্দ থাকে।   ইতিহাস বলছে মধ্যযুগে বাংলায় কোনোভাবে মিশে গেছিলো হিন্দু ও মুসলিম ধর্ম। এর ফলেই শুরু হয় সত্যপীর পুজোর। এই পীর শব্দটি হলো এক ফার্সী শব্দ। শব্দগত ভাবে এর অর্থ হলো 'জ্ঞানী'। মূলতঃ অর্থে যিনি আল্লাহ পাকের সাথে রুহানী সংযোগ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ,ওনাকেই পীর সাহেব বলা হয়। কুরান শরীফ ,হাদীছ শরীফে যাদের আউলিয়া ,মুর্শিদ ও শায়খ বলা হয় ফার্সীতে তাদেরই পীর সাহেব বলা হয়। ঠিক যেমন হিন্দুদের কাছে গুরু,যিনি ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যাওয়ার পথ দেখান।
"গুশব্দশ্চান্ধকারঃ স‍্যাদ্রুশব্দসন্নিরোধকঃ।
অন্ধাকারনিরোধিত্বাৎ গুরুরিত‍্যাভিধীয়তে।।"
গু শব্দের অর্থ হলো অন্ধকার আর রু শব্দের অর্থ হলো নিরোধক। অন্ধকার বা অজ্ঞানকে যিনি নিরুদ্ধ করেন তাঁকেই গুরু বলা হয়। গুরুস্তোত্রে আছে,
"অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানঞ্জনশলকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।"
--অর্থাৎ, অজ্ঞানতিমিরে আচ্ছন্ন ব্যক্তির চক্ষুকে যিনি জ্ঞানরূপ শলাকা দ্বারা উন্মোচন করেন  তিনিই গুরু।
মঙ্গলকাব্য এবং সত্যনারায়নের ব্রতকথা অনুযায়ী, সত্যনারায়ন মুসলিম ফকিরের রূপ ধরে এক গরীব ব্রাহ্মণের কাছে আসেন। তাঁকে বলেন,তুমি আমাকে পুজোর সিন্নি দিলে আমি তোমার দারিদ্র্য, দুঃখ,কষ্ট দূর করবো। কিন্তু মুসলিম ফকিরের এমন কথা গরীব ব্রাহ্মণ মানতে নারাজ হলেন। ফকির রূপী নারায়ণ বুঝে যান, ব্রাহ্মণ 'মুসলিম' এর কথায় বিশ্বাস করছেন না। ফকির রূপ ধারণ অবস্থাতেই তিনি বলেন, সত্যনারায়ন ও সত্যপীরের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।সবই এক। এরপরই তিনি তাঁর আসল নারায়ণ রূপ ধারণ করেন। আসলে লোককথাগুলিতে নারায়ণ এবং পীর মিশ্রিত হয়েছেন। যেমন একজন সাধক তাঁকে সত্যনারায়ন রূপে সম্বোধন করেন যিনি কৃষ্ণের অবতার; আবার এই সত্যনারায়নই সত্যপীর যিনি মক্কা থেকে এসেছেন যা তাঁকে মুসলিম পরিচয় প্রদান করে। বাংলার নিকটবর্তী উড়িষ্যা রাজ্যটিতে সুফিবাদ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সত্যপীর ঐতিহ্যের উত্থানকে নেতৃত্ব দেয়। এমনকি আজও হিন্দুরা একসঙ্গে সত্যনারায়ন ও সত্যপীরের পুজো করে। বাংলাদেশে কিছু বৌদ্ধদের মাঝেও সত্যপীরের পুজো করা হয়।
       সিঙ্গুর স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে পড়ে বুড়িগ্রাম। এই বুড়িগ্রামের শেষ প্রান্তে মাঠের মাঝখানে পড়ে এই সত্যপীরের মন্দির। এই মন্দিরকে চাইলে মসজিদ, মাজারও বলা যায়। স্থানীয়রা সত্যপীর তলা বলেই ডাকে।  এই মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু, এই মসজিদ তথা মন্দিরের বয়েস কয়েকশো বছর। সত্যপীরের সঙ্গে যে কি ভাবে যেন জড়িয়ে গেছেন সত্যনারায়ন।  এই পুজোর প্রধান অঙ্গই হলো সিন্নি। এই সিন্নি আসলে 'শিরনি'।মুসলিম সম্প্রদায় অনুযায়ী এই 'শিরনি' হলো আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্যে নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী খাবার উৎসর্গ করা। যেমন কেউ দেয় বাতাসা, কেউ দেয় দানাদার, কেউ দেয় পায়েস আবার কেউ দেয় ছোলার ডাল মাংস দিয়ে পোলাও ,কেউ দেয় ক্ষীর। অর্থাৎ, কারুর মনের কথা পুরো হলেই আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্যে খাবার উৎসর্গ করে সবার মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়। কারণ নর রূপে যে নারায়ণ অর্থাৎ পীর বাস করে। পীরও সত্য নারায়ণও সত্য। গ্রাম বাংলার মানুষের মধ্যে তাই এই দুয়ের কোনো বাঁধ নেই। যে নারায়ণ ভজে, সে অনায়াসে আসতে পারে পীরের কাছেও। মানত করতে পারে নির্দ্বিধায়। পীর তার কাছে ঠাকুর বৈ তো অন্য কিছু নয়। এই ঠাকুরকে উপাসনা করার অধিকার হিন্দু মুসলিমের সমান। এই পীরকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে হিন্দু মুসলমানের এক অপূর্ব ভ্রাতৃত্ববোধ। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষরা কিন্তু কোনোদিনই পীরকে নিজের সম্পত্তি মনে করেনি। বরং গরমের হাত থেকে বাঁচতে দুই ধর্মের মানুষই ভীড় জমায় গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা সত্যাপীরের বেদিতে। চলে গামছায় বাঁধা মুড়ি আর সদ্য জমি থেকে তোলা শশার ভাগাভাগি। জলপান চলে সত্যপীরের পুকুরে। প্রতি মাসের একটি বৃহস্পতিবার হলো বাবার বার। ঐ দিন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে জমা হয় সত্যপীর তলায়। কেউ পুজো করে, কেউ পড়ে নামাজ।"
            সাহিত্যে পারদর্শী ফাহিমের কথা শেষ হওয়ার  সাথে সাথেই আকাশে পূর্ণ চন্দ্রের উপস্থিতি তার জ্যোৎস্না নিয়ে আর ঠাকুর মশাই মাথা দোলাতে দোলাতে ব্রতকথা পাঠ করছেন,
"পীর বলে আজই হৈতে দুঃখ গেলো দূর ,
অতুল সম্পদ হৈল যাও নিজ পুর।
নিশ্চই তোমারে কহি ,আমি সত্যপীর,
কলিযুগে পৃথিবীতে হয়েছি জাহির।।"
        পুজো শেষ হতেই পরম যত্নে সুস্বাদু খাবার সিন্নি প্রসাদ খেতে খেতে কন্যা আমার বললো,"ঐতিহ্যের সঙ্গে মুখশুদ্ধি।  এই চাঁদ হিন্দু মুসলিম দুই ধর্মের কাছেই প্রিয়। চাঁদ, দুই দশায় দু রকম অনুষ্ঠানের সূচনা। কিন্তু চাঁদ,এক অনন্ত। তেমন ধর্ম ভিন্ন মানুষ কিন্ত সবাই।"
ফাহিম তার দৃপ্ত ভঙ্গিতে বললো,"শ্রী ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে শ্রী বিষ্ণুর স্তবে আছে,
"ত্বং ব্রহ্ম পরমং ধাম নিরীহো নিরহংকৃতিঃ ।
 নির্গুণশ্চ নিরাকারঃ সাকারঃ স্বগুণঃ স্বয়ম্।।
তেজস্তবং চাপি তেজস্বী জ্ঞানং জ্ঞানী চ তৎপরঃ।
বেদেহনির্বচনীয়স্তবং কস্তাবং স্তোতুমিহেশ্বরঃ।।"
       অর্থাৎ, হে প্রভু, আপনিই ব্রহ্ম তথা পরমধাম, ইচ্ছারহিত ,অহংকার শূন্য, নির্গুণ এবং নিরাকার হইয়াও স্বয়ং স্বগুণ সাকার রূপধারী।। আপনিই সমস্ত তেজস্বী গণেরও তেজ এবং জ্ঞানী গণেরও পরম জ্ঞান স্বরূপ। সেইজন্য শাস্ত্র আপনাকে বেদের অনির্বচনীয় রূপে কীর্ত্তন করিয়াছে , অতএব আপনাকে স্তব করিতে কেই বা সমর্থ হবে ?
    আবার কুরআন র তালীম হচ্ছে,
"কূল হুয়াল্লহু আহাত।
 আল্লাহুস সমাদ।
লাম ইয়ালিদ ওয়ালাম ইয়ুলাদ।
ওয়ালাম ইয়াকুল্লাহু কুফু আন আহাত।।"
সূরা এখলাছ :
১- বলুন,তিনি আল্লাহ, এক,
২- আল্লাহ অমুখাপেক্ষী,
৩- তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয়নি,
৪- এবং ,তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।"
            জ্যোৎস্না ভেজা নরম চাঁদের আলোয় মাঝের মোকাম পরম যত্নে আমার কন্যা ফাহিমের হাতে তুলে দিচ্ছে এখন , এখন ঠিক এই মুহূর্তেই মিলে যাচ্ছে যেনো নারায়ণ আর পীর...সবার ওপরে যে মানুষ সত্য। মানুষের সাথে মানুষ মিশে, জেগে থাকে মানবতা ,কখনো সে সত্যনারায়ণ কখনো সে সত্যপীর।
     
               

সুমি ভট্টাচার্য্য
তথ্যসূত্র : বিভিন্ন ওয়েবসাইট।


Post a Comment

0 Comments