ফরাসডাঙার ভালোবাসা---একটি অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প
'ঘুম - ঘুম চাঁদ
ঝিকিমিকি তারা ,
এই মাধবী রাত।
আসেনি তো বুঝি আর জীবনে আমার...'
ফরাসডাঙার গা ঘেঁষে জাহ্নবীর অবিরাম গতিতে বয়ে চলা আর চাঁদের হাসির বাঁধ যখন প্রেমের পূর্ণতা খোঁজে, তখন আত্মজার সাথে হাতে হাত রেখে গান গাইতে গাইতে হাঁটার অনুভূতি সত্যিই যেন প্রাণের আরাম,মনের বিরাম। প্রেমের পূর্ণতা, যে আত্মজা আমার। আত্মজা, যে আমার সবটুকু আদর ভালোবাসা দিয়েই পূর্ণ। যে আমার মেঘপরী, আমার শীতের নরম রোদের তৃপ্তি , আমার সবটুকু জুড়ে শুধুই যে সে। কিশোরী থেকে যৌবনের দিকে চলেছে আমার ফরাসডাঙার কিশোরী ,তাই তার নবীন মনে কতো প্রশ্ন। আজ আমাকেই পূর্ণ চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,"আচ্ছা মা, তুমি আমাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসো কিন্ত আজ আমাকে তুমি একটা অন্য ভালোবাসার গল্প বলবে ? আজ যে ভীষণ শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে এক অন্য ভালোবাসার গল্প। বলো না মা, বলবে না ?" আত্মজার এই হঠাৎ প্রশ্নে মন যখন উথাল পাথাল,তখনই আমার মুঠোফোনের আলোয় দেখলাম ফুটে উঠেছে কিছু কথা -
একটি অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প
একটা গল্প লিখলাম আজ।
চাঁদ নোলক রাতের কোলে ভাপা সংক্রান্তি
পৌষ গাইছে জল নূপুর পুকুর পায়ে।
আড়ি আড়ি ভাব ভাব...আলস্যের আলাপ
শির শির কাটছে গুঁড়ো শিশির মশগুলে,
আর আমার অপেক্ষায় তুমি,
ঠিক যেমন রাত, ভোরের অপেক্ষায়।
কখনো গৃহস্থ্যের গর্ভে,
কখনো বা কোনো বোধি বৃক্ষের তলায়,
জরা,মৃত্যুর ভয়কে শাসন করে আলাদিন ইচ্ছে।
তুমি ভাব তুমি থাকবে আমার জাতক কথায়।
আমিও তো রাজীই ছিলাম প্রেম,কিন্তু ক্ষনিকের ভুল।
ভুলে গেলাম ও নারী, একা ছাড়তে পারিনা যে তোমায়....................
কেন তুমি একলা জাগলে রাত ?
ও নারী, একটা গল্প লিখলাম আজ।
কাব্য যেখানে গদ্য ছুঁয়ে আছে।
.....একটা গল্প বলাই হলো না আজ।
কথা নয় ব্যথার শব্দগুলি পড়ে মন যখন টান টান পিছুটান, আমার অবচেতনের অসম্পূর্ণতা ,আমার অধরা, আমার মনের ভেতর যার অস্তিত্বের ছোঁয়া তাকে ঠেলে, তার কথা বড়ো মনে পড়ছে যখন,
"চাঁদ ঝর্ণা হাওয়ায়, নিজেকে পাওয়ায় মিষ্টি ভালোবাসা আছে। যাকে মুছতে নেই বুঝতে হয় বুকের কাছে টেনে।"
ফোনে ফুটে উঠল তারই নাম।কেন হয় এমন, এখনই কেন ? প্রশ্নের কাছে হারিয়ে না গিয়ে আবেশে ভরা মনে শুধু তাকে বললাম,"একটু পরে কথা বলি তোমার সাথে।"
স্মৃতির অতল থেকে আত্মজার মা ডাক ফিরিয়ে আনলো আমায় আর আমার আপন মনের হাসি দেখে সে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,"ও মা,তুমি হাসছো কেন ? আমায় বলো না একটা অন্য ভালোবাসার গল্প।" কন্যাকে স্থির করার জন্য তাই শুরু করলাম বলতে,"আয়, আজ তোকে এক অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্পই বলি। তুই শুনেছিস এন্টনী ফিরিঙ্গির নাম ?"
কন্যা বললো,"হ্যাঁ, শুনেছি তো। এন্টনী ফিরিঙ্গি যে আমাদের চন্দননগরের সাথেই জড়িয়ে।"
তখন বললাম ,"তবে আয়, আজ তোকে বলি এন্টনী ফিরিঙ্গির গল্প। এই এন্টনীর ছিলো এক সৌদামিনি। আজ এই যে চাঁদ দেখে আমরা গান গাইছি এই চাঁদেরই আরেকটা নাম হলো সৌদামিনি। এন্টনীর জীবনেও ছিলো এক সৌদামিনি, যে এন্টনীকে ফিরিঙ্গি থেকে কবিয়াল বানানোর ছিলো নেপথ্যে। এই ফরাসডাঙার কবিয়াল এন্টনী ফিরিঙ্গিকে নিয়ে বলতে গেলে রাত দিন হয়ে যাবে দিন রাত হয়ে যাবে তবুও সে ভালোবাসার কথা শেষ হবার নয়। এই এন্টনী ফিরিঙ্গি যার আসল নাম হ্যান্সম্যান এন্টনী। ওনার জন্ম ১৭৮৬ সালে এবং মৃত্যু ১৮৩৬ সালে। এই মানুষটি হলেন প্রথম ইউরোপীয় বাংলা ভাষার কবিয়াল। শোনা যায়, তাঁর বাবা ছিলেন পর্তুগিজ এবং মা ছিলেন বাঙালি। এই হ্যান্সম্যান যেহেতু ইউরোপীয় ছিলেন ,সেহেতু তাঁকে ফিরিঙ্গি আখ্যা দেওয়া হয়। এই ফিরিঙ্গি শব্দটি মূলতঃ,'ফিরঙ্গ' শব্দের অপভ্রংশ।সংস্কৃত অভিধান 'শব্দকল্পদ্রুম' এ 'ফিরঙ্গ' শব্দের উল্লেখ আছে। 'ফিরঙ্গ দেশ' বলতে সে সময় পাশ্চাত্য দেশগুলিকেই বোঝানো হতো। ভারত চন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর ' অন্নদামঙ্গল' সাহিত্যে, ফিরিঙ্গি বলতে শুধু পর্তুগিজদেরই উল্লেখ করেছেন। আসলে ইউরোপীয়দের সাথে ভারতীয়দের মিশ্রণে উৎপন্ন জাতিকেই ফিরিঙ্গি বলা হয়। এভাবেই, হ্যান্সম্যান এন্টনী হয়ে ওঠেন এন্টনী ফিরিঙ্গি। এই পর্তুগিজ হ্যান্সম্যান এন্টনী ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চলে আসেন এই বাংলাতে। আর হুগলী জেলার ফরাসডাঙা অধুনা চন্দননগর তো নিজের ভালোবাসার ইতিহাস লেখার জন্য স্বাগত জানালো এক পর্তুগিজকে পর্তুগিজ শব্দে, "AMIGOS bem-vindo em Farashdanga" অর্থাৎ ফরাসডাঙায় আপনাকে স্বাগত এন্টনী কবিয়াল।
ফরাসডাঙায় মূলত এন্টনীর আসা নুনের গোলার চাকরি করতে ।যে ঠাকুরদের নুনের গোলায় তিনি চাকরি করতেন তা বর্তমানে নোনাটোলা নামে পরিচিত। কিন্তু শুধুই তো নুনের গোলার চাকরি নয় তার আসল ভালোবাসা ছিলো গানবাজনা। এন্টনী ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির মানুষ। এই সময় তাঁর পরিচয় হয় কয়েকজন গাঁজাখোরের সঙ্গে। এঁরা অবশ্য সমাজের মান্য গণ্য কোনো মানুষ ছিলেন না। কেউ নাপিত কেউ ধোপা এমনই সব স্তরের মানুষ ছিলেন ওরা।আর এন্টনীর নিজের জাতভাইদের সাথে মেশার থেকে এদের সাথে মিশে বেশি মনের সুখ পেতেন। এদের সাথে গাঁজা টানা, গান গাওয়া আর কবিগানের আসরে যাওয়ার মধ্যে উনি সুখ বেশি অনুভব করতেন। তখন ছিলো, কবিগানের রমরমার যুগ।সেইসময় কোনো পার্বন মানেই এই কবিগানের আসর বসতো। মূলতঃ, এই কবিগানের জন্যই তিনি তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন। এই কবিগানেই তাঁর পরিচিতি। এই কবিগান আসলে হলো, লোকসঙ্গীতের একটি বিশেষ ধারা। এই ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশ গ্রহন করে থাকেন। গায়ককে কবি হতে হয়।তিনি মুখে মুখে পদ রচনা করেন এবং তাৎক্ষণিক ভাবে সুরারোপ করে গেয়ে থাকেন। কবিগান পরিবেশনকারীদের বলা হয় কবিয়াল। তিনি তখনকার জনপ্রিয় কবিগান ও কবির লড়াইয়ের প্রতি এতই আকৃষ্ট হন যে নিজের দল গঠন করেন এবং তখনকার বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা, ঠাকুর সিংহ, রাম বসু প্রভৃতির সাথে কবি গানের লড়াই এ অংশ গ্রহণ করেন। তিনি বাংলা ভাষার ওপর অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন এবং তাঁর রচিত কবিগান খুবই জনপ্রিয় হয়। সেইসময় থেকেই তিনি এন্টনী কবিয়াল নামে জনপ্রিয় হয়ে যান।সাহেব কবিয়াল বাঙালি পোশাকে কবিগান গাইছেন সেটাই ছিলো সেই যুগে এক অভিনব দৃশ্য। বলাই বাহুল্য, তিনিই ছিলেন প্রথম ইউরোপীয় বাংলা ভাষার সাহিত্যিক।
এন্টনী কিন্তু একদিনেই কবিয়াল হয়ে ওঠেন নি, তাঁর গলায় সুর ছিল, শেখার আগ্রহ ছিলো এবং তাঁর গানের গলাটি ও বেশ মিষ্টি ছিলো। তিনি শুনে শুনে এমন সুন্দর পরিষ্কার উচ্চারণে গান গাইতেন যে দূর থেকে কেউ শুনলে বুঝতেই পারতো না যে একজন ফিরিঙ্গি গাইছে। এন্টনীকে কবিয়াল তৈরি করেছিলেন নিজের ভালোবাসা, যত্ন, পরিচর্যা নিয়ে সেই অন্তঃপুরবাসিনি, অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে যা চলে আসছে । এক সফল পুরুষ মানুষের পশ্চাতে থাকে এক নারীর ভূমিকা। এই ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটলো, কারণ এক খ্রিষ্টানকে এক বাঙালি গৃহবধূ সম্পূর্ণ রূপে জানালো কৃষ্ণলীলা, মা দূর্গা, কালী এবং হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য। এন্টনী সেই নারীর দৃষ্টিভঙ্গিতে চিনলো, জানলো হিন্দু ধর্মের রীতি নীতি।
এরপরের গল্প সে তো সবারই জানা। সৌদামিনি(মতান্তরে নিরুপমা) কে দুঃখ যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি দিতে ত্রাতা রূপে স্বয়ং এন্টনীর আগমন এবং মাথার ওপর আকাশ ও পায়ের নীচের মাটিকে সাক্ষী রেখে সৌদামিনিকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া। আসলে নারী যে সহজাত ভাবেই কোমল। সে ধরা দিতে চায় তার ভালোবাসার পুরুষের কাছে, বাঁধতে চায় নিজেকে সম্পর্কের বাঁধনে ;যেখানে সে পায় তার প্রাপ্য সম্মান। তাদের দুজনের ভালোবাসাও স্বার্থক হলো। পূর্ণতা পেলো সৌদামিনি নারী জন্মের মাতৃত্বের স্বাদ পেয়ে। কিন্তু প্রদীপের নীচেই যে অন্ধকার থাকে। মাতৃত্বের স্বাদ শারীরিক , মানসিক ভাবে অনুভব করলেও নিজের শরীরের অংশকে স্পর্শ করে দেখার আগেই গর্ভের সন্তান আর গর্ভধারিনী মা দুজনকেই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হলো , তথাকথিত ধর্মের মহাত্ম্যের গুণে। ভালোবাসার পুরুষ মানুষের কথা চরম মুহূর্তে মনে করেও কোনো নারী যে ,কাপুরুষদের জান্তব উল্লাসের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি তা যুগ যুগ ধরেই হয়ে আসছে।
এন্টনী যখন এসে পৌঁছলো তখন দূর থেকেই সে ধ্বংস স্তুপ দেখতে পেলো। পাগলের মতো দৌড়োতে দৌড়োতে এসে দেখলো তার ভালোবাসা শেষ ,তার স্বপ্নের সংসার তার ভবিষ্যত সব শেষ। পড়ে আছে শুধু বুকফাটানো চিৎকারের হু হু করা হাহাকার। শেষ সত্যিই এমন কিছু জিনিসেরও হয়, যেখান থেকে আর শুরু হবার কোনো আশাও থাকে না।এন্টনী তার সর্বশ্রান্ত ভেঙে পড়া শরীরকে টেনে নিয়ে চললো। সে তার সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলো ফরাসডাঙার সাথে তার স্মৃতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
তারপর সে যে কোথায় হারিয়ে গেলো তার খোঁজ আর কেউ পেলো না, আসলে মানুষ যখন নিজেকেই হারিয়ে ফেলে তখন তাকে আর কেউ খুঁজে পায় না। এন্টনী যদি সেদিন সৌদামিনিকে একা না ছাড়তো তবে হয়তো গল্পটা অন্য রকম হতো।
এন্টনী ফিরিঙ্গি থেকে এন্টনী কবিয়াল হওয়ার যাত্রাটুকু আমরা সবাই জানি তাকে আর নতুন করে বলার কিছুই নেই, কিন্তু তার পরবর্তী ইতিহাস আজও আমাদের কাছে অজানা রয়ে গেছে। এন্টনী কি সত্যিই কবিয়াল হয়েছিলো ? এন্টনীর প্রেম যে ছিলো শুধুই কবিগান, তার সেই কবিগান অসম্পূর্ণ থেকে গেলো তার সৌদামিনির মৃত্যুর সাথে সাথে। অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো তাদের ভালোবাসা, তার পরিপূর্ণ কবিয়াল হয়ে ওঠার স্বপ্ন। ভালোবাসার মানুষের সাথে সংসার করার স্বপ্ন যে অসম্পূর্ণ স্বপ্নই রয়ে গেলো। ফরাসডাঙার কবিয়ালকে নিয়ে শুধুমাত্র একটাই কথা ভেবে অবাক হয়েছি এমনও কি সত্যিকারের পুরুষ মানুষ ছিলো পৃথিবীতে যে এক অতি সাধারণ বাল্য বিধবার কষ্ট, তার মানসিক যন্ত্রণা বুঝেছিলো ! তার ছোটো ছোটো ইচ্ছা, অনিচ্ছার সম্মান করেছিলো, নারী হয়েও তার কথার মান রেখেছিল আর সব থেকে বড়ো কথা আদরে সোহাগে ভালোবাসায় তাকে পূর্ণ করেছিলো যা যুগ যুগ ধরে প্রতিটি নারীর মনের কথা হয়ে থাকে। এই ভাবেই ইতিহাসের এক সত্যিকারের প্রেম উপাখ্যানের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যায়।"
এই গল্প শুনেই উদাস গলায় আমার কন্যা বলে উঠলো,"মা,এ গল্প যে দুঃখের! এমন গল্প তুমি কেন বললে আমায় ? আমি যে তোমার গল্প শুনতে চেয়েছিলাম। "
কন্যাকে বললাম, " তোকে আমার গল্প আর কি বলবো ; আমার গল্পে যে চাঁদ নেই, আমার গল্পে যে ...।" অসম্পূর্ণ কথা মনেতেই সম্পূর্ণতা পেলো,"আমার গল্পে যে চাঁদ নেই ,আমার গল্পে আছে সূর্য। সূর্য যে আমার কাছে বন্ধুত্বের অপর নাম। পিতৃহারা ছোট্ট একটা মেয়ের হাত নিজের দীপ্তিতে একদিন ধরেছিলো সূর্য। সেই হাতের শক্ত বাঁধন আজও সে আলগা করেনি নিজের উজ্জ্বল প্রভায়। সে বাঁধন আজও আছে দৃঢ় ,আর সময়ের সাথে সাথে দৃঢ় বাঁধন যেন দৃঢ়তম হয়ে উঠছে। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ নিঙড়ে,ভালোবাসা দিয়ে মনের জমানো কথা, ব্যাথ্যা যে শুধুমাত্র তাকেই বলা যায়। চোখ বুজে নির্ভরতা আর বিশ্বাসের অপর নামই যে সূর্য আমার।"
চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে গেল মুঠোফোনের বাঁশির সুরে আর পর্দায় সূর্যের নাম ফুটে ওঠাতে। যে আমার একমুঠো রোদ একমুঠো উষ্ণতা আমার বন্ধুত্ব জীবনের পরম পাওয়া। ফোন ধরতেই আমি তার কাছ নিজের পরে কথা বলছি বলার জন্য ক্ষমা চাওয়ার আগেই সে গান গেয়ে বলে উঠলো,
"তোমাকে চেয়েছিলাম আমি অনেক জন্ম আগে
তথাগত তাঁর নিঃসঙ্গতা দিলেন অস্তরাগে
তাঁরই করুণায় ভিখারিনী তুমি হয়েছিলে একা একা
আমিও কাঙাল হলাম... আরেক কাঙালের পেতে দেখা।
নতজানু হয়ে ছিলাম তখনো, এখনও যেমন আছি।
মাধুকরী হও... নয়ন মোহিনী... স্বপ্নের কাছাকাছি।"
আসলে সূর্যের মতো করে বুঝতে আমায় বোধকরি কেউ পারেনি,তাই আমার হৃদয়ের অতি গোপন অভিমান, ভালোবাসা, অনুভূতি সেই একমাত্র অনুভব করতে পেরেছে। কারণ অভিমান ,রাগ অনুরাগ এতই গোপন প্রকোষ্ঠে থাকে মানুষের যে, যে কেউ সেখানে হাত ছোঁয়াতে পারেনা। আমার ভাবনার সাথে প্রেম আমার সূর্যের ,যা অসম্পূর্ণ থেকেই গেলো। সূর্য বললে যেমন উজ্জ্বল আলো মনে হয় ঠিক তেমনি আমার সূর্যের কথা হলেই মনে হয় ভালো রাখার আবেগ। যে আজও দূরে থেকেও আমায় প্রতিটি মুহূর্তে ভালো রেখে চলেছে। তাই মনে হয়,
"বন্ধু মানে মস্ত আকাশ
আকাশ ভরা নীল।
বন্ধু মানে দখিন হাওয়া
উড়ন্ত গাংচিল।
বন্ধু মানে জড়িয়ে ধরা হঠাৎ অচম্বিতে
তার দু'চোখে নিজেকে দেখা নয়ন আর্শীতে।"
আত্মজার ডাকে চকিত ভাঙলো যখন, তখন সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ,"মা, চুপ করে আছো কেন ? বলছো না কেন কিছু ?" তখন তাকে বললাম,'থাক না মা, আমার গল্প। সব গল্প কি আর সম্পূর্ণ হয় ? আমার গল্প নাহয় "এক অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প"ই হয়ে থাক।'
আমার খুব চেষ্টার লুকোনো চোখের জল আত্মজার চোখে ধরা পড়ে গেলো কিন্তু সেই ধরা পড়া চোখের জলের কারণ সে আমার থেকে জানতে চাইলো না। সে তার আপন বয়সের নিয়মে ততক্ষণে বোধ করি বুঝে গেছে যে সব প্রেম সম্পূর্ণতা পায় না। কিছু ভালোবাসা অসম্পূর্ণ থেকেই যায় সম্পূর্ণতার আশায়। কন্যা তার আপন খুশিতেই বলে উঠলো,"তবে চলো মা, আমরা আবার গান গাই। কিন্তু এবার তুমি নয় প্রথমে, এবার গানের পালা যে আমার।" বলেই এই কথা সে গেয়ে উঠলো,
"আমি যামিনী তুমি শশী হে,
ভাতিছ গগন মাঝে।
মম সরসীতে তব উজল প্রভা,
বিম্বিত যেন লাজে।।"
একবিংশ শতাব্দীর কিশোরীর কাছে এমন গানের প্রত্যাশা করিনি, তাই আমার অবাক চোখ আর প্রচ্ছন্ন গর্ব বোধকরি তারও চোখ এড়িয়ে গেলো না। কিন্তু আত্মজা যে আমার পূর্ণ প্রেম, আমার পরিপূর্ণতা কি সেখানে ? আমার অসম্পূর্ণ প্রেমও কি এন্টনীর অসম্পূর্ণ গল্পের মতোই অসম্পূর্ণ ভালোবাসা হয়ে রয়ে গেলো? আত্মজা নাহোক কিন্তু আত্মার শক্তিশালী বন্ধন হয়ে থাকুক আমার সূর্য আমার কাছে। আমার সূর্যের মতোই আমার ঠাকুরও যে প্রতিটি অনুভূতি ছুঁয়ে গেছে আমার, তাই যে মনে হয়,
"তুমি বন্ধু, তুমি নাথ, নিশিদিন তুমি আমার।
তুমি সুখ, তুমি শান্তি, তুমি হে অমৃতপাথার।।
তুমিই তো আনন্দলোক, জুড়াও প্রাণ,নাশো শোক,
তাপহরণ তোমার চরণ অসীমশরণ দীনজনার।।"
জন্মান্তরেও যেন সূর্যকেই পাই এমন পবিত্র থাক অন্তর আমার,তাই যেটুকু পাওয়া সেটুকুই আঁকড়ে রাখি মুঠোতে আমার। আত্মজার সাথে গলা মিলিয়ে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না তাই ফরাসডাঙার কিশোরীর হাত ধরে ফরাসডাঙার পাশে বয়ে যাওয়া গঙ্গার তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে গেয়ে উঠলাম,
"আমি যামিনি তুমি শশী হে,
ভাতিছ গগন মাঝে..."
সুমি ভট্টাচার্য্য ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : কবিতা: "একটি অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প"---শ্রী সৌরিন্দ্র বেজ ।
তথ্য সূত্র : বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
'ঘুম - ঘুম চাঁদ
ঝিকিমিকি তারা ,
এই মাধবী রাত।
আসেনি তো বুঝি আর জীবনে আমার...'
ফরাসডাঙার গা ঘেঁষে জাহ্নবীর অবিরাম গতিতে বয়ে চলা আর চাঁদের হাসির বাঁধ যখন প্রেমের পূর্ণতা খোঁজে, তখন আত্মজার সাথে হাতে হাত রেখে গান গাইতে গাইতে হাঁটার অনুভূতি সত্যিই যেন প্রাণের আরাম,মনের বিরাম। প্রেমের পূর্ণতা, যে আত্মজা আমার। আত্মজা, যে আমার সবটুকু আদর ভালোবাসা দিয়েই পূর্ণ। যে আমার মেঘপরী, আমার শীতের নরম রোদের তৃপ্তি , আমার সবটুকু জুড়ে শুধুই যে সে। কিশোরী থেকে যৌবনের দিকে চলেছে আমার ফরাসডাঙার কিশোরী ,তাই তার নবীন মনে কতো প্রশ্ন। আজ আমাকেই পূর্ণ চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,"আচ্ছা মা, তুমি আমাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসো কিন্ত আজ আমাকে তুমি একটা অন্য ভালোবাসার গল্প বলবে ? আজ যে ভীষণ শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে এক অন্য ভালোবাসার গল্প। বলো না মা, বলবে না ?" আত্মজার এই হঠাৎ প্রশ্নে মন যখন উথাল পাথাল,তখনই আমার মুঠোফোনের আলোয় দেখলাম ফুটে উঠেছে কিছু কথা -
একটি অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প
একটা গল্প লিখলাম আজ।
চাঁদ নোলক রাতের কোলে ভাপা সংক্রান্তি
পৌষ গাইছে জল নূপুর পুকুর পায়ে।
আড়ি আড়ি ভাব ভাব...আলস্যের আলাপ
শির শির কাটছে গুঁড়ো শিশির মশগুলে,
আর আমার অপেক্ষায় তুমি,
ঠিক যেমন রাত, ভোরের অপেক্ষায়।
কখনো গৃহস্থ্যের গর্ভে,
কখনো বা কোনো বোধি বৃক্ষের তলায়,
জরা,মৃত্যুর ভয়কে শাসন করে আলাদিন ইচ্ছে।
তুমি ভাব তুমি থাকবে আমার জাতক কথায়।
আমিও তো রাজীই ছিলাম প্রেম,কিন্তু ক্ষনিকের ভুল।
ভুলে গেলাম ও নারী, একা ছাড়তে পারিনা যে তোমায়....................
কেন তুমি একলা জাগলে রাত ?
ও নারী, একটা গল্প লিখলাম আজ।
কাব্য যেখানে গদ্য ছুঁয়ে আছে।
.....একটা গল্প বলাই হলো না আজ।
কথা নয় ব্যথার শব্দগুলি পড়ে মন যখন টান টান পিছুটান, আমার অবচেতনের অসম্পূর্ণতা ,আমার অধরা, আমার মনের ভেতর যার অস্তিত্বের ছোঁয়া তাকে ঠেলে, তার কথা বড়ো মনে পড়ছে যখন,
"চাঁদ ঝর্ণা হাওয়ায়, নিজেকে পাওয়ায় মিষ্টি ভালোবাসা আছে। যাকে মুছতে নেই বুঝতে হয় বুকের কাছে টেনে।"
ফোনে ফুটে উঠল তারই নাম।কেন হয় এমন, এখনই কেন ? প্রশ্নের কাছে হারিয়ে না গিয়ে আবেশে ভরা মনে শুধু তাকে বললাম,"একটু পরে কথা বলি তোমার সাথে।"
স্মৃতির অতল থেকে আত্মজার মা ডাক ফিরিয়ে আনলো আমায় আর আমার আপন মনের হাসি দেখে সে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,"ও মা,তুমি হাসছো কেন ? আমায় বলো না একটা অন্য ভালোবাসার গল্প।" কন্যাকে স্থির করার জন্য তাই শুরু করলাম বলতে,"আয়, আজ তোকে এক অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্পই বলি। তুই শুনেছিস এন্টনী ফিরিঙ্গির নাম ?"
কন্যা বললো,"হ্যাঁ, শুনেছি তো। এন্টনী ফিরিঙ্গি যে আমাদের চন্দননগরের সাথেই জড়িয়ে।"
তখন বললাম ,"তবে আয়, আজ তোকে বলি এন্টনী ফিরিঙ্গির গল্প। এই এন্টনীর ছিলো এক সৌদামিনি। আজ এই যে চাঁদ দেখে আমরা গান গাইছি এই চাঁদেরই আরেকটা নাম হলো সৌদামিনি। এন্টনীর জীবনেও ছিলো এক সৌদামিনি, যে এন্টনীকে ফিরিঙ্গি থেকে কবিয়াল বানানোর ছিলো নেপথ্যে। এই ফরাসডাঙার কবিয়াল এন্টনী ফিরিঙ্গিকে নিয়ে বলতে গেলে রাত দিন হয়ে যাবে দিন রাত হয়ে যাবে তবুও সে ভালোবাসার কথা শেষ হবার নয়। এই এন্টনী ফিরিঙ্গি যার আসল নাম হ্যান্সম্যান এন্টনী। ওনার জন্ম ১৭৮৬ সালে এবং মৃত্যু ১৮৩৬ সালে। এই মানুষটি হলেন প্রথম ইউরোপীয় বাংলা ভাষার কবিয়াল। শোনা যায়, তাঁর বাবা ছিলেন পর্তুগিজ এবং মা ছিলেন বাঙালি। এই হ্যান্সম্যান যেহেতু ইউরোপীয় ছিলেন ,সেহেতু তাঁকে ফিরিঙ্গি আখ্যা দেওয়া হয়। এই ফিরিঙ্গি শব্দটি মূলতঃ,'ফিরঙ্গ' শব্দের অপভ্রংশ।সংস্কৃত অভিধান 'শব্দকল্পদ্রুম' এ 'ফিরঙ্গ' শব্দের উল্লেখ আছে। 'ফিরঙ্গ দেশ' বলতে সে সময় পাশ্চাত্য দেশগুলিকেই বোঝানো হতো। ভারত চন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর ' অন্নদামঙ্গল' সাহিত্যে, ফিরিঙ্গি বলতে শুধু পর্তুগিজদেরই উল্লেখ করেছেন। আসলে ইউরোপীয়দের সাথে ভারতীয়দের মিশ্রণে উৎপন্ন জাতিকেই ফিরিঙ্গি বলা হয়। এভাবেই, হ্যান্সম্যান এন্টনী হয়ে ওঠেন এন্টনী ফিরিঙ্গি। এই পর্তুগিজ হ্যান্সম্যান এন্টনী ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চলে আসেন এই বাংলাতে। আর হুগলী জেলার ফরাসডাঙা অধুনা চন্দননগর তো নিজের ভালোবাসার ইতিহাস লেখার জন্য স্বাগত জানালো এক পর্তুগিজকে পর্তুগিজ শব্দে, "AMIGOS bem-vindo em Farashdanga" অর্থাৎ ফরাসডাঙায় আপনাকে স্বাগত এন্টনী কবিয়াল।
ফরাসডাঙায় মূলত এন্টনীর আসা নুনের গোলার চাকরি করতে ।যে ঠাকুরদের নুনের গোলায় তিনি চাকরি করতেন তা বর্তমানে নোনাটোলা নামে পরিচিত। কিন্তু শুধুই তো নুনের গোলার চাকরি নয় তার আসল ভালোবাসা ছিলো গানবাজনা। এন্টনী ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির মানুষ। এই সময় তাঁর পরিচয় হয় কয়েকজন গাঁজাখোরের সঙ্গে। এঁরা অবশ্য সমাজের মান্য গণ্য কোনো মানুষ ছিলেন না। কেউ নাপিত কেউ ধোপা এমনই সব স্তরের মানুষ ছিলেন ওরা।আর এন্টনীর নিজের জাতভাইদের সাথে মেশার থেকে এদের সাথে মিশে বেশি মনের সুখ পেতেন। এদের সাথে গাঁজা টানা, গান গাওয়া আর কবিগানের আসরে যাওয়ার মধ্যে উনি সুখ বেশি অনুভব করতেন। তখন ছিলো, কবিগানের রমরমার যুগ।সেইসময় কোনো পার্বন মানেই এই কবিগানের আসর বসতো। মূলতঃ, এই কবিগানের জন্যই তিনি তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন। এই কবিগানেই তাঁর পরিচিতি। এই কবিগান আসলে হলো, লোকসঙ্গীতের একটি বিশেষ ধারা। এই ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশ গ্রহন করে থাকেন। গায়ককে কবি হতে হয়।তিনি মুখে মুখে পদ রচনা করেন এবং তাৎক্ষণিক ভাবে সুরারোপ করে গেয়ে থাকেন। কবিগান পরিবেশনকারীদের বলা হয় কবিয়াল। তিনি তখনকার জনপ্রিয় কবিগান ও কবির লড়াইয়ের প্রতি এতই আকৃষ্ট হন যে নিজের দল গঠন করেন এবং তখনকার বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা, ঠাকুর সিংহ, রাম বসু প্রভৃতির সাথে কবি গানের লড়াই এ অংশ গ্রহণ করেন। তিনি বাংলা ভাষার ওপর অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন এবং তাঁর রচিত কবিগান খুবই জনপ্রিয় হয়। সেইসময় থেকেই তিনি এন্টনী কবিয়াল নামে জনপ্রিয় হয়ে যান।সাহেব কবিয়াল বাঙালি পোশাকে কবিগান গাইছেন সেটাই ছিলো সেই যুগে এক অভিনব দৃশ্য। বলাই বাহুল্য, তিনিই ছিলেন প্রথম ইউরোপীয় বাংলা ভাষার সাহিত্যিক।
এন্টনী কিন্তু একদিনেই কবিয়াল হয়ে ওঠেন নি, তাঁর গলায় সুর ছিল, শেখার আগ্রহ ছিলো এবং তাঁর গানের গলাটি ও বেশ মিষ্টি ছিলো। তিনি শুনে শুনে এমন সুন্দর পরিষ্কার উচ্চারণে গান গাইতেন যে দূর থেকে কেউ শুনলে বুঝতেই পারতো না যে একজন ফিরিঙ্গি গাইছে। এন্টনীকে কবিয়াল তৈরি করেছিলেন নিজের ভালোবাসা, যত্ন, পরিচর্যা নিয়ে সেই অন্তঃপুরবাসিনি, অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে যা চলে আসছে । এক সফল পুরুষ মানুষের পশ্চাতে থাকে এক নারীর ভূমিকা। এই ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটলো, কারণ এক খ্রিষ্টানকে এক বাঙালি গৃহবধূ সম্পূর্ণ রূপে জানালো কৃষ্ণলীলা, মা দূর্গা, কালী এবং হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য। এন্টনী সেই নারীর দৃষ্টিভঙ্গিতে চিনলো, জানলো হিন্দু ধর্মের রীতি নীতি।
এরপরের গল্প সে তো সবারই জানা। সৌদামিনি(মতান্তরে নিরুপমা) কে দুঃখ যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি দিতে ত্রাতা রূপে স্বয়ং এন্টনীর আগমন এবং মাথার ওপর আকাশ ও পায়ের নীচের মাটিকে সাক্ষী রেখে সৌদামিনিকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া। আসলে নারী যে সহজাত ভাবেই কোমল। সে ধরা দিতে চায় তার ভালোবাসার পুরুষের কাছে, বাঁধতে চায় নিজেকে সম্পর্কের বাঁধনে ;যেখানে সে পায় তার প্রাপ্য সম্মান। তাদের দুজনের ভালোবাসাও স্বার্থক হলো। পূর্ণতা পেলো সৌদামিনি নারী জন্মের মাতৃত্বের স্বাদ পেয়ে। কিন্তু প্রদীপের নীচেই যে অন্ধকার থাকে। মাতৃত্বের স্বাদ শারীরিক , মানসিক ভাবে অনুভব করলেও নিজের শরীরের অংশকে স্পর্শ করে দেখার আগেই গর্ভের সন্তান আর গর্ভধারিনী মা দুজনকেই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হলো , তথাকথিত ধর্মের মহাত্ম্যের গুণে। ভালোবাসার পুরুষ মানুষের কথা চরম মুহূর্তে মনে করেও কোনো নারী যে ,কাপুরুষদের জান্তব উল্লাসের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি তা যুগ যুগ ধরেই হয়ে আসছে।
এন্টনী যখন এসে পৌঁছলো তখন দূর থেকেই সে ধ্বংস স্তুপ দেখতে পেলো। পাগলের মতো দৌড়োতে দৌড়োতে এসে দেখলো তার ভালোবাসা শেষ ,তার স্বপ্নের সংসার তার ভবিষ্যত সব শেষ। পড়ে আছে শুধু বুকফাটানো চিৎকারের হু হু করা হাহাকার। শেষ সত্যিই এমন কিছু জিনিসেরও হয়, যেখান থেকে আর শুরু হবার কোনো আশাও থাকে না।এন্টনী তার সর্বশ্রান্ত ভেঙে পড়া শরীরকে টেনে নিয়ে চললো। সে তার সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলো ফরাসডাঙার সাথে তার স্মৃতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
তারপর সে যে কোথায় হারিয়ে গেলো তার খোঁজ আর কেউ পেলো না, আসলে মানুষ যখন নিজেকেই হারিয়ে ফেলে তখন তাকে আর কেউ খুঁজে পায় না। এন্টনী যদি সেদিন সৌদামিনিকে একা না ছাড়তো তবে হয়তো গল্পটা অন্য রকম হতো।
এন্টনী ফিরিঙ্গি থেকে এন্টনী কবিয়াল হওয়ার যাত্রাটুকু আমরা সবাই জানি তাকে আর নতুন করে বলার কিছুই নেই, কিন্তু তার পরবর্তী ইতিহাস আজও আমাদের কাছে অজানা রয়ে গেছে। এন্টনী কি সত্যিই কবিয়াল হয়েছিলো ? এন্টনীর প্রেম যে ছিলো শুধুই কবিগান, তার সেই কবিগান অসম্পূর্ণ থেকে গেলো তার সৌদামিনির মৃত্যুর সাথে সাথে। অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো তাদের ভালোবাসা, তার পরিপূর্ণ কবিয়াল হয়ে ওঠার স্বপ্ন। ভালোবাসার মানুষের সাথে সংসার করার স্বপ্ন যে অসম্পূর্ণ স্বপ্নই রয়ে গেলো। ফরাসডাঙার কবিয়ালকে নিয়ে শুধুমাত্র একটাই কথা ভেবে অবাক হয়েছি এমনও কি সত্যিকারের পুরুষ মানুষ ছিলো পৃথিবীতে যে এক অতি সাধারণ বাল্য বিধবার কষ্ট, তার মানসিক যন্ত্রণা বুঝেছিলো ! তার ছোটো ছোটো ইচ্ছা, অনিচ্ছার সম্মান করেছিলো, নারী হয়েও তার কথার মান রেখেছিল আর সব থেকে বড়ো কথা আদরে সোহাগে ভালোবাসায় তাকে পূর্ণ করেছিলো যা যুগ যুগ ধরে প্রতিটি নারীর মনের কথা হয়ে থাকে। এই ভাবেই ইতিহাসের এক সত্যিকারের প্রেম উপাখ্যানের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যায়।"
এই গল্প শুনেই উদাস গলায় আমার কন্যা বলে উঠলো,"মা,এ গল্প যে দুঃখের! এমন গল্প তুমি কেন বললে আমায় ? আমি যে তোমার গল্প শুনতে চেয়েছিলাম। "
কন্যাকে বললাম, " তোকে আমার গল্প আর কি বলবো ; আমার গল্পে যে চাঁদ নেই, আমার গল্পে যে ...।" অসম্পূর্ণ কথা মনেতেই সম্পূর্ণতা পেলো,"আমার গল্পে যে চাঁদ নেই ,আমার গল্পে আছে সূর্য। সূর্য যে আমার কাছে বন্ধুত্বের অপর নাম। পিতৃহারা ছোট্ট একটা মেয়ের হাত নিজের দীপ্তিতে একদিন ধরেছিলো সূর্য। সেই হাতের শক্ত বাঁধন আজও সে আলগা করেনি নিজের উজ্জ্বল প্রভায়। সে বাঁধন আজও আছে দৃঢ় ,আর সময়ের সাথে সাথে দৃঢ় বাঁধন যেন দৃঢ়তম হয়ে উঠছে। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ নিঙড়ে,ভালোবাসা দিয়ে মনের জমানো কথা, ব্যাথ্যা যে শুধুমাত্র তাকেই বলা যায়। চোখ বুজে নির্ভরতা আর বিশ্বাসের অপর নামই যে সূর্য আমার।"
চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে গেল মুঠোফোনের বাঁশির সুরে আর পর্দায় সূর্যের নাম ফুটে ওঠাতে। যে আমার একমুঠো রোদ একমুঠো উষ্ণতা আমার বন্ধুত্ব জীবনের পরম পাওয়া। ফোন ধরতেই আমি তার কাছ নিজের পরে কথা বলছি বলার জন্য ক্ষমা চাওয়ার আগেই সে গান গেয়ে বলে উঠলো,
"তোমাকে চেয়েছিলাম আমি অনেক জন্ম আগে
তথাগত তাঁর নিঃসঙ্গতা দিলেন অস্তরাগে
তাঁরই করুণায় ভিখারিনী তুমি হয়েছিলে একা একা
আমিও কাঙাল হলাম... আরেক কাঙালের পেতে দেখা।
নতজানু হয়ে ছিলাম তখনো, এখনও যেমন আছি।
মাধুকরী হও... নয়ন মোহিনী... স্বপ্নের কাছাকাছি।"
আসলে সূর্যের মতো করে বুঝতে আমায় বোধকরি কেউ পারেনি,তাই আমার হৃদয়ের অতি গোপন অভিমান, ভালোবাসা, অনুভূতি সেই একমাত্র অনুভব করতে পেরেছে। কারণ অভিমান ,রাগ অনুরাগ এতই গোপন প্রকোষ্ঠে থাকে মানুষের যে, যে কেউ সেখানে হাত ছোঁয়াতে পারেনা। আমার ভাবনার সাথে প্রেম আমার সূর্যের ,যা অসম্পূর্ণ থেকেই গেলো। সূর্য বললে যেমন উজ্জ্বল আলো মনে হয় ঠিক তেমনি আমার সূর্যের কথা হলেই মনে হয় ভালো রাখার আবেগ। যে আজও দূরে থেকেও আমায় প্রতিটি মুহূর্তে ভালো রেখে চলেছে। তাই মনে হয়,
"বন্ধু মানে মস্ত আকাশ
আকাশ ভরা নীল।
বন্ধু মানে দখিন হাওয়া
উড়ন্ত গাংচিল।
বন্ধু মানে জড়িয়ে ধরা হঠাৎ অচম্বিতে
তার দু'চোখে নিজেকে দেখা নয়ন আর্শীতে।"
আত্মজার ডাকে চকিত ভাঙলো যখন, তখন সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ,"মা, চুপ করে আছো কেন ? বলছো না কেন কিছু ?" তখন তাকে বললাম,'থাক না মা, আমার গল্প। সব গল্প কি আর সম্পূর্ণ হয় ? আমার গল্প নাহয় "এক অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প"ই হয়ে থাক।'
আমার খুব চেষ্টার লুকোনো চোখের জল আত্মজার চোখে ধরা পড়ে গেলো কিন্তু সেই ধরা পড়া চোখের জলের কারণ সে আমার থেকে জানতে চাইলো না। সে তার আপন বয়সের নিয়মে ততক্ষণে বোধ করি বুঝে গেছে যে সব প্রেম সম্পূর্ণতা পায় না। কিছু ভালোবাসা অসম্পূর্ণ থেকেই যায় সম্পূর্ণতার আশায়। কন্যা তার আপন খুশিতেই বলে উঠলো,"তবে চলো মা, আমরা আবার গান গাই। কিন্তু এবার তুমি নয় প্রথমে, এবার গানের পালা যে আমার।" বলেই এই কথা সে গেয়ে উঠলো,
"আমি যামিনী তুমি শশী হে,
ভাতিছ গগন মাঝে।
মম সরসীতে তব উজল প্রভা,
বিম্বিত যেন লাজে।।"
একবিংশ শতাব্দীর কিশোরীর কাছে এমন গানের প্রত্যাশা করিনি, তাই আমার অবাক চোখ আর প্রচ্ছন্ন গর্ব বোধকরি তারও চোখ এড়িয়ে গেলো না। কিন্তু আত্মজা যে আমার পূর্ণ প্রেম, আমার পরিপূর্ণতা কি সেখানে ? আমার অসম্পূর্ণ প্রেমও কি এন্টনীর অসম্পূর্ণ গল্পের মতোই অসম্পূর্ণ ভালোবাসা হয়ে রয়ে গেলো? আত্মজা নাহোক কিন্তু আত্মার শক্তিশালী বন্ধন হয়ে থাকুক আমার সূর্য আমার কাছে। আমার সূর্যের মতোই আমার ঠাকুরও যে প্রতিটি অনুভূতি ছুঁয়ে গেছে আমার, তাই যে মনে হয়,
"তুমি বন্ধু, তুমি নাথ, নিশিদিন তুমি আমার।
তুমি সুখ, তুমি শান্তি, তুমি হে অমৃতপাথার।।
তুমিই তো আনন্দলোক, জুড়াও প্রাণ,নাশো শোক,
তাপহরণ তোমার চরণ অসীমশরণ দীনজনার।।"
জন্মান্তরেও যেন সূর্যকেই পাই এমন পবিত্র থাক অন্তর আমার,তাই যেটুকু পাওয়া সেটুকুই আঁকড়ে রাখি মুঠোতে আমার। আত্মজার সাথে গলা মিলিয়ে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না তাই ফরাসডাঙার কিশোরীর হাত ধরে ফরাসডাঙার পাশে বয়ে যাওয়া গঙ্গার তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে গেয়ে উঠলাম,
"আমি যামিনি তুমি শশী হে,
ভাতিছ গগন মাঝে..."
সুমি ভট্টাচার্য্য ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : কবিতা: "একটি অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প"---শ্রী সৌরিন্দ্র বেজ ।
তথ্য সূত্র : বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
2 Comments
বেশ সুন্দর ...পরবর্তী লেখাটির জন্য অপেক্ষায় রইলাম ।
ReplyDeleteঅনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনার ভালো লাগাই প্রাপ্তি আমার। খুব ভালো থাকবেন।
DeletePosting any kind of spam in comment section is prohibited
Emoji