পথ থেকে আবাসে
-ইন্দ্রনীল দাস অধিকারী
প্রায় তখন সকাল দশটা। অজস্র পদধ্বনি জান কোলাহলে শহর কলকাতা ব্যস্ত মুখরিত। দৌড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের বাটি এগিয়ে ধরে আছে একটা শীর্ণ কোমল হাত । ফুটপাতের রেলিংঙে ঠেস দিয়ে তিন ফুটের লিকলিকে খসখসে দেহটা। অন্য হাতে তার ভাইয়ের হাত। সেও এইরকম অপুষ্ট ,জীর্ণ ,নোংরা পোশাকে আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতার চমৎকার সাবজেক্ট।
সকাল সন্ধ্যা শহরের কেন্দ্রে প্রান্তে ও উপকণ্ঠে ঘুরে বেড়ায় অসংখ্য ভিখারি। ভিক্ষাই এদের পূর্ণাঙ্গ ও আংশিক জীবিকা, এরা বিভিন্ন বয়সের ,মাতৃভাষা দেশ আলাদা। তফাৎ আছে বেঁচে থাকার প্রকরণে। তফাৎ আছে আরও অনেক কিছুতে। তবে মূল সূর- একটাই এরা সবাই ভিখারি।
এরকমই একজন ভিখারি হঠাৎ এক সকালে ধরা পরল পুলিশের হাতে। অবশ্য সে অনেকক্ষণ বুঝতেও পারেনি যে পুলিশ তাকে ধরেছে। কেননা সে কোন অন্যায় করেনি -প্রতিদিন যেমন ইডেন গার্ডেনের একটা কলাপসিবল গেটের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে পেতে রাখে- দক্ষিণ হাত একটু দক্ষিণা পাওয়ার প্রত্যাশায় ।তেমনি বসেছিল সেদিনও -কোন অন্যায় তো করেনি। তা এদিকে ওদিক থেকে দু চারজন ভদ্রলোক জামা প্যান্ট পরা একজন ভদ্রমহিলা এসে বললেন - "ওঠো ওঠো খানা মিলেগা চালো"।।ওরা কি বলছেন ভালো করে বোঝার চেষ্টায় একটু সময় ব্যয় হয়ে যায়। ইতিমধ্যে দুজন ওনার হাত ধরেছেন গলার স্বরের পরিবর্তন এসেছে ওদের -ধমকের সুরে বলছেন -"চলো চলো"। বাধা দেবার প্রশ্ন উঠছেন না কারণ -খেতে দেবে বলেছে। অগ্যতা সে উঠে বসে পুলিশের গাড়িতে।
একজন মহিলাকে তোলা হলো ওই গাড়িতে ওই একই এলাকা থেকে বোধহয় খিচুড়ি বা ওই ধরনের কিছু খাচ্ছিল হাতে মুখে হলুদ খাওয়ার লেগে রয়েছে আর একটু দূরে গিয়ে ধরা হলো আরো একজনকে বয়স ৩০ থেকে ৩৫। এক প্রৌঢ় একটা পুটলি মাথায় দিয়ে শুয়েছিল রেড রোডের ফুটপাথে। রোগা শান্ত চেহারার মানুষটি খুব একটা অপরিচ্ছন্ন নন। পড়নে ফুল প্যান্ট আর জামা পায়ে চটিও আছে, চলো বলতেই উঠে পড়লেন গাড়িতে। ঠিক এইভাবে সংগ্রহ করা হল ৩৫ জনকে।
পুলিশ এদের ধরল কেন? এরা কি অপরাধ করেছে? যাদের ধরা হলো তাদের মধ্যে কয়েকজন তো, দৃশ্যত মানসিক ভারসাম্যহীন - এরা কি অপরাধ করবে? বাকিরা অত্যন্ত গরিব - কেউ কেউ তো ভিক্ষাই করে। কিন্তু সেই অপরাধে কি পুলিশ এদের ধরতে পারে? ভিক্ষা করা তো আমাদের দেশে কোন দিন অপরাধ বলে বিবেচিত হয়নি। গৌতম বুদ্ধ ,চৈতন্যদেব ভিক্ষা ছাড়া ক্ষুন্নিবৃত্তি করতেন না। দ্বার থেকে দ্বারে ফিরেছেন ভিক্ষাপাত্র হাতে। আইনের দৃষ্টিতে ভিখারিকে অপরাধী বলাই যায়। কিন্তু সাধারণভাবে ভিক্ষা করাকে সমাজ আজ হেয় চোখে দেখলেও ভিখারিকে ঠিক অপরাধী বলে ভাবে না । বরং একটু করুণার দৃষ্টিতে ভিখারিদের দেখা হয় । ওরা অনেক সময় ঘেনঘেন করে বটে - ভিক্ষা পাওয়ার জন্য নানা রকম ফন্দি-ফিকির করে, তবু পুলিশে ধরার মতো অপরাধ যেন এসব নয়।
না পুলিশ এদের আসামী হিসেবে ধরেনি, উপকার করার বাসনায় এদেরকে ধরা হয়েছে নিজের ভালো এরা নিজেরা বোঝে না তাই এদের ভালো করতে গেলে একটু জোর খাটাতে হয় আর এই জোর টুকো খাটানো হয় আইনের নির্দেশেই। এবং তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল "ভ্রাগন্ট হোমে" কলকাতার এই রকমের হোম প্রায় লক্ষ্য করা যায়। এখানে তাদেরকে থাকার ব্যবস্থা দেওয়া হয়, খাওয়ানো হয় ,চিকিৎসা পর্যন্ত করা হয়, সেই সঙ্গে নানা রকম প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা দেওয়া হয় ।কিছু কর্মচারী যাদেরকে বলা হয় "হেল্পার", তারা ওই সকালে নিয়ে আসা ৩৫ জনকে পরিষ্কার করে , নতুন জামা কাপড় পরিয়ে, ভোজন করালো। তারপর ওই হোমেরি একটি ফাঁকা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল যেখানে একজন সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত ছিলেন ,যেখানে এদের সবার নাম নেওয়া হল আর তাদের মধ্যে ২৫ জনকে ভবঘুরে হিসেবে চিহ্নিত করা হলো এবং বাকি ১০ জনকে আপাতত একটা জায়গায় রাখা হল। সন্ধ্যা হল কিছু লোক এলো এবং দশজনের দাম দিয়ে তাদেরকে নিয়ে গেলো । কি ভাবছেন অন্য কোন হোম থেকে লোক এসেছিল ?? আজ্ঞে না তারা একটি সংস্থা থেকে এসেছিলেন এবং এই ১০ জনকে কিনে নিয়ে গেলেন দিন- দুপুর- সন্ধ্যা শহরের বিভিন্ন জায়গায় এদেরকে" শিফটিং ডিউটি" দেওয়া হলো "ভিক্ষার"এই সমস্ত সংস্থা যারা অনাথদের, ভিখারিদের কে নিয়ে ব্যবসা করে। এবং দিনের রোজগার হিসেবে তাদের পারিশ্রমিক বিচার করে। আর সরকারিভাবেও যে ২৫ জনকে ভবঘুরে হিসেবে নির্বাচিত করা হলো , তাদেরকে আবার যে জায়গা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল সেখানেই আবার রেখে আসা হলো। এতে সরকারও বোঝ মুক্ত আর অসাধু ব্যবসায়ীরাও খুশি।। আদৌ কি !!এই সমাজের নিপীড়িত -লাঞ্চিত -বঞ্চিত মানুষজন যারা দুবেলা খেতে পায়না মানে "ভিখারি" বা না খেতে পাওয়া মানুষ তাদেরকে কি সত্যিই পথ থেকে তুলে কোন আবাসে নিয়ে যাওয়া হল?? না তাদেরকে নিয়ে ব্যবসা করা হল ?? একেই কি আমরা খালিচোখে সমাজ সেবা বলে থাকি?
আমাদের চারপাশে পরিচিত সমাজে যারা ,থেকেও না থাকার মত বেঁচে থেকেও মৃতের সামিল ,সেইসব না -মানুষ ভিখারিদের দিকে আমরা উদাসীন ভাবে তাকিয়ে কপালে তর্জনি ঠেকাই, কখনো সিকি - আধুলি দানে শ্লাঘা বোধকরি অথবা শুধুই বিড়বিড় করি- "মাফ করো"।
কিভাবে দিন কাটান এরা ? এদের জীবনবোধ ও মূল্যবোধের ইতিহাস কি ? আমরা কি কেবলই দর্শক? রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব? ভিখারি মুক্ত সমাজ কি সম্ভব? কিছু প্রশ্ন আপনাদের জন্য স্থগিত থাক।।।।।
0 Comments
Posting any kind of spam in comment section is prohibited
Emoji