সততা



করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে চারিদিকে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে কোভিড-১৯ রোগ। এই রোগ প্রতিরোধে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে পুরো বিশ্ব।
                 খাদ্যের অভাব যেনো দিনে দিনে মাথা চাড়া দিচ্ছে। অভাবে স্বভাব নষ্ট। এই কথা তো শুনেই আসছি ছোটো থেকে কিন্তু এই কথা যে ভুলও হতে পারে, তা প্রমাণিত হয়ে গেল। খাওয়ার টানাটানি, খাওয়ার কষ্ট কি জিনিস এখনো অবধি আমার অজানাই ছিলো আমার আব্বু আম্মির জন্য। আসলে খাওয়া কেনো, কোনো কষ্টই আমাকে আজ অবধি স্পর্শ করতে পারি নি তাদের জন্য।
                  Lockdown period চলার জন্য আব্বু বেশ কিছুদিনের খাবার জোগাড় করে রেখেছিলো। খাবার যখন প্রায় শেষের দিকে তখন বাজারে গিয়েছিলো আব্বু । যদিও প্রতিদিন সেই মানুষটাকে নিজের কাজের সূত্রে বেরোতেই হয়। কাজ যেহেতু মানুষের প্রাণ বাঁচানোর । আমার আব্বুর আছে এক ওষুধের দোকান। এই দুর্বিষহ দিনে যখন মানুষ প্রাণের ভয়ে নিজের ঘর টুকুর মধ্যেই সুরক্ষিত আছে, তখন আব্বু আমার এই করোনা নামক রোগকে উপেক্ষা করে নিয়মিত পায়ে হেঁটে রোদে জলে ছুটছে দোকানের উদ্দেশ্যে। দোকানের নাম  'Life Save' স্বার্থক আমার আব্বুর অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্যই। প্রাণ  বাঁচানোর কাজ করে যে আব্বু আমার।
                    আব্বু বাজার থেকে ফিরেই আমাদের জানিয়েছিলো মুড়ির দাম নাকি আগুন ছুঁয়ে যাচ্ছে। মুড়ি হয়তো আর পাওয়া যাবে না। আমি খানিক অভিমানের বশেই বলেছিলাম ,"অনেকদিনের বাজার দোকান করে রাখলেই হয়। কি দরকার দু তিন সপ্তাহ অন্তর যাওয়ার। আমাদের তো অভাব কিছুরই নেই। যারা এতো দাম বাড়িয়ে এই দুর্দিনে খাওয়ার জিনিস বিক্রি করছে তারা তো অসৎ। তোমার কি দরকার এতো কষ্টের ? বাড়ির অল্প বেঁচে থাকা মুড়ি তো তুমি দিয়ে দিলে নিজের খাওয়ার সময়, যে ভিক্ষা করতে এসেছিলো তাকে। চাল আলু দিয়ে তাকে কি বিদায় দেওয়া যেতো না ?" আব্বু তার আদরের হাত আমার মাথায় রেখে বলেছিলো,"যারা এই দুর্দিনে মানুষের খাদ্যের সাথে এই ভুল কাজ করছে তারা একদিন ঠিক নিজের ভুল বুঝতে পারবে। আজ তোকে একটা গল্প বলি শোন, একবার এক কাগজে পড়েছিলাম 'সততা স্টোর' বলে সততা চর্চার এক প্ল্যাটফর্ম আছে। সেখানে ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েদের জন্য থাকে খাতা, কলম, লজেন্স, বিস্কুটের প্যাকেট, অন্যান্য শিক্ষা সামগ্রী। সেই ঘরে ঢুকে পড়ুয়ারা নিজেদের প্রয়োজন মতো জিনিস তুলে নিচ্ছে। এরপর যে জিনিসের যা দাম সেই অনুযায়ী তার টাকা রাখছে পাশে রাখা একটি বাক্সে।  এখানে নেই কোনো দোকানি, নেই কোনো নজরদারি ক্যামেরা। দোকানের একটি জিনিস কেউ অতিরিক্ত নিলে বা তার দাম না দিলে দেখার কেউ নেই তবুও সবাই পাশ করেছে সততায়। যা অমূল্য এই সময়ে। আত্মশুদ্ধি করে এই সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করবে নতুন প্রজন্ম।
         আর রইলো মুড়ির কথা, মুড়ি সেই মুহূর্তে যাকে দিলাম তার কাছে তখন ওটাই ছিলো পেটের আগুন নেভানোর জিনিস। চাল আলু সে তার পরিবারের জন্য নিয়ে গিয়ে তবেই খেতে পাবে। তার দিকে যে গোটা পরিবার তাকিয়ে। আর এবার আসি অনেক দিনের বাজার দোকান কেনো আমি করে রাখছি না ,তার কথা বলি তোকে। আজ আমি যদি প্রায় দু'তিন মাসের খাওয়ার জোগাড় করে রাখি তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না ঠিক কথা। কিন্তু যে গরিব মানুষগুলো এই দুর্দিনে আছে তারা কি করবে ? তাদের অল্প রোজগার অল্প টাকা। দিন আনে দিন খায় যারা তারা একসঙ্গে পারবে না অধিক জিনিস কিনে রাখতে। আর তারাই যখন দোকানে যাবে নিজেদের প্রয়োজনের জিনিস তারা পাবে না। জানিস ,একেই বলে অসৎ হওয়া। ওই ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েগুলো যদি তদারকি ছাড়াই নিজেদের সততা প্রমাণিত করে, তবে আমরা কেনো নয়?"
                   আমি অবাক চোখে পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী মানুষের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার খুব চেষ্টার লুকিয়ে রাখা চোখের জল ঠিক ধরা পড়ে গেলো আমার সুপারম্যানের কাছে। পৃথিবীর সব থেকে নিরাপদ জায়গায় , পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী মানুষটা আমাকে বুকে যখন টেনে নিলো, তখন একটাই কথা শুধুমাত্র মনে আসছিলো,
        "পিতা স্বর্গ , পিতা ধর্ম,
               পিতাহি পরমং তপঃ,
           পিতরি প্রিতিমা, পন্নে প্রিয়ন্তে,
                  সর্ব দেবতাঃ ।।"
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে জিততে হলে আমাদের এই উদ্যোগ হয়তো যথেষ্ট নয়, কিন্তু আমরা যদি সবাই যে যার সামর্থ্য মতো এগিয়ে আসি তাহলে আমরা জিতবই। আমার আব্বুর মতো মানুষ যারা মানুষের বিপদের সময় পাশে এসে দাঁড়ায় তারা যদি সোজা হয়ে দাঁড়ায় তবে ঝুঁকে থাকা মানুষগুলো সোজা হয়ে দাঁড়াবে তাড়াতাড়ি নিশ্চয়ই।

কলমে : ফাহিমা নারজিশ

Post a Comment

0 Comments